Sunday 5 July 2020

পাওলো পাসোলিনি-র কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০, অনুবাদঃ হিন্দোল ভট্টাচার্য


পাওলো পাসোলিনি-র কবিতা 
অনুবাদ- হিন্দোল ভট্টাচার্য

যুদ্ধের দিনগুলির কবিতা

পৃথিবীর সমস্ত অস্ত্র যত রক্তহীন তত ঠান্ডা। যেন মর্গ থেকে উঠে এসেছে। যেন তাদের কোনও ঈশ্বর নেই, মা-বাবা নেই, প্রেমিক-প্রেমিকাও অপেক্ষা করছে না। পৃথিবীর সমস্ত অস্ত্রের ভিতর ঘাপটি মেরে বসে থাকে আদিম সরীসৃপ। তাদের শীতল জিভে কী প্রবল খিদে! মানুষ নিজের ছায়ার উপরে ঢেলে দেয় প্রতিহিংসাগুলো। আমরা অপেক্ষা করি।

আমাদের চোখের সামনে থেকে সরে গেল পর্দা। জ্বলে উঠল আলো। আমরা সেই আলোর দিকে তাকিয়ে রইলাম। কী ঠান্ডা আলো! যেন যুদ্ধের সার্চলাইট। আজ সমস্ত ক্ষুধার্ত নেকড়ের মুখ আমি মানচিত্রের মতো দেখি। কে এক এসেছে আমাদের শহরে আজ, নরকের আত্মা থেকে কী বিশাল হাঁমুখ এক আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। আমাদের চোখের সামনে এত আলো! এত আলো, তবু তার অন্ধকার তত বেশি উজ্জ্বল এখন!

অপমানগুলোর কথা মনে রেখো। মনে রেখো, আমরা কেউ সৈন্য হয়ে জন্মাইনি। একটি ফুলের কথাও মনে রেখো। মনে রেখো, ঘাসের লনের কথা। পাহাড়ের গায়ে এঁকে বেঁকে উঠে যাওয়া রাস্তাটির কথা। মেয়েটার কথাও মনে রেখো, যার একটা বাচ্চা ভেড়া ছাড়া আর কেউ নেই।

বিশ্বাস করি না তবু, নতমস্তকে স্বীকার করি, তুমিই ঈশ্বর। বলি, তুমিই ঈশ্বর। আরও চিৎকার করে বলি, হ্যাঁ, তুমিই ঈশ্বর। নিজের গলা নিজেই দুহাতে চেপে ধরে বলি, হ্যাঁ হ্যাঁ তুমিই ঈশ্বর। আত্মহত্যা করতে করতে বলি, তুমিই একমাত্র ঈশ্বর। বিশ্বাস করি না, তবু,মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও বলি, হে ঈশ্বর, আমাকে বাঁচাও। ঈশ্বর মৃদু হাসেন। সেফটি ক্যাচের শব্দ হয় ঘড়ির ভিতর।

ব্রিজের উপরে ঠান্ডা মেয়েটি

একটা গাঢ় অন্ধকার বাড়ি থেকে সে বেরিয়ে আসত প্রতিদিন। কী শীতল যে তার চোখদুটি! ভাগ্যিস তুমি নিজের দিকে তাকাওনি কোনওদিন, বলতাম। সে হেসে ফেলত। তার হাসির সঙ্গে সঙ্গে ঝরে পড়ত বিষাক্ত হেমন্ত। আমি বলতাম, আমি তো সুন্দরের স্বপ্ন দেখেছিলাম। সে একটা আগুনের পরিখার মধ্যে দিয়ে এসে দাঁড়াত এই ব্রিজে। যার তলা দিয়ে বয়ে গেছে রক্তাক্ত এক নদী। আমি বলে উঠতাম কেন আমার দুঃস্বপ্ন হয়েই থেকে গেলে! সে এসব শুনে আমাকে চুমু খেতে এগিয়ে আসত। আমি তার মুখের ভিতর ঢুকে পড়তাম। সে আমাকে শুষে নিত এক ভেজা অন্ধকারের ভিতর। আলো ছিল না কোনও। আর তার পর হো হো করে হেসে আমাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিত। আমি শ্বাস নিতাম। আমি দেখতাম একটা খেলনার পৃথিবী তার খেলনার মতো মানুষজন নিজেদের দিকে বেয়নেট উদ্যত করে আছে। কেউ ভালো নেই, কেউ ভালো থাকবে না, এমন তো কথা ছিল না বিয়াত্রিচে! সে ফিরে যেত তার অদ্ভুত বাড়ির দিকে। অন্ধকার বাড়ি। চারিদিকে আশ্চর্য বাগান। সেখানে কিছু অন্তর্বাস হাওয়ায় উড়ছে। আমি চেষ্টা করেও এই ব্রিজ পেরোতে পারিনি। সেও এপারে আসেনি কখনও। একটি গাঢ় অন্ধকার বাড়ি আমাদের অন্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে প্রতিদিন।


(পাওলো পাসোলিনি একজন ইতালিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক। ১৯২২-১৯৭৫। চলচ্চিত্র পরিচালনা ছাড়াও তিনি লিখেছিলেন প্রচুর প্রবন্ধ, কবিতা এবং গল্প। তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।)
  

বর্ণালী কোলের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০



দুটি কবিতা
বর্ণালী কোলে


গৃহবধূ

বিকেলে বারান্দায় দাঁড়াও তুমি
তোমার ম্লান চোখ

একদিন দরজা খুলে 
চলে যাবে দিগন্তে?

মেঘে কুটির বাঁধো

তোমার বর হোক
সন্ধের পথে হাঁটা জীবনানন্দ


তিরস্কার

কেন মেজাজ হারিয়েছিলে, কেন?

তোমার তো দরকার ধ্যান
তোমার তো অশ্বত্থের বৃক্ষ

Friday 3 July 2020

পৃথা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০







মেঘের অলক
পৃথা চট্টোপাধ্যায়

ঘন হয়ে ছেয়ে গেলে সমস্ত আকাশ
ধানখেতে মেলে দাও
সজল শরীর
দূর বন্য অন্তরাল থেকে
জেগে ওঠো তুমি
সুঠাম আলস্য ভাঙা দেহ

এই কি  প্রথম দেখা জীবনের পর্যটক তটে !
আমার শরীর ভেঙে কবিতার প্রেম
কুচোকুচো মেঘ এসে মিশে যায়
কদমের ফুলে

দিশেহারা হয়ে যায় নিয়মেরা
মেঘের অলক থেকে
আলটুসি খসে পড়ে
অলস দুপুর
বৃষ্টিরেণু মেখে

Thursday 2 July 2020

সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০, উইসলাওয়া সিমবোরস্কা,




Wislawa Szymborska উইসলাওয়া সিমবোরস্কা (১৯২৩ - ২০১২) পোল্যান্ডের কবি। ১৯৯৬ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী ।

অনুবাদ : অভিজিৎ পালচৌধুরী

স্বপ্নকে ভালোবেসে ..

আমার স্বপ্নে আমি
ভারমির ভ্যান ডেলফ্টের মত আঁকি

অনর্গল গ্রিক বলি
এবং তা শুধু জীবিতদের সাথেই নয়

একটা গাড়ি চালাই
যেটা আমি যা করাতে চাই, করে

আমি নিজে প্রতিভাশালী
এবং শক্তিশালী মহাকাব্য লিখি

পরিষ্কার কন্ঠস্বর শুনি
যে কোনো শ্রদ্ধাভাজন সন্ন্যাসীর মতো

পিয়ানোবাদক হিসেবে আমার প্রতিভা
তোমাকে মুগ্ধ করবে

আমাদের যেভাবে ওড়া উচিত
সেভাবেই উড়ি, মানে নিজে নিজেই

ছাদ থেকে লাফিয়ে
ঘাসের ওপর ধীরে নেমে আসি

জলের নিচে শ্বাস নিতে
আমার কোন সমস্যা নেই

নালিশ জানাতে পারি না
অ্যাটলান্টিসকে খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছি

এটাই সন্তোষের যে মৃত্যুর আগে 
আমি সর্বদা জেগে উঠতে পারি

যুদ্ধ শুরু হলেই
আমার অন্যদিকে গড়িয়ে যাই

আমি আমার বয়সী একটি শিশু
কিন্তু আমার সেটা হবার দরকার নেই

কয়েক বছর আগে
দু'টো সূ্র্য দেখেছিলাম

এবং গতরাতের আগের রাতে 
একটি পেঙ্গুইন
দিনের মতো পরিষ্কার  ।।



মেঘপুঞ্জ

মেঘের বর্ণনা করতে
আমাকে খুব তৎপর হতে হবে 
তাদের জন্য একটা মুহূর্তের ভগ্নাংশ যথেষ্ট 
অন্য কিছু হয়ে যেতে 

তাদের ট্রেডমার্ক :
কোন একটি বিশেষ আকার, রঙ, ভঙ্গিমা 
এবং বিন্যাস যা তারা কখনো পুনরাবৃত্তি করে না 

কোনরকম স্মৃতি ভারে 
ভারাক্রান্ত না হয়ে তারা 
সহজেই বাস্তবের ওপর ভেসে বেড়ায় 

পৃথিবীর কোন ঘটনায় 
তাদের সাক্ষ্য বহন করতে হয় ? 
যখনই কিছু ঘটে, তারা ছড়িয়ে যায় 

মেঘের সাথে তুলনা করলে 
জীবন শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে 
বাস্তবিকই স্থায়ী, প্রায় চিরায়ত 

মেঘের পরে 
এমনকি একটা পাথরকেও ভাই মনে হয় 
যার ওপর তুমি নির্ভর করতে পারো 
যেখানে মেঘেরা শুধুমাত্র দূরে
ভেসে যাওয়া তুতো-ভাইয়ের দল 

মানুষকে থাকতে দাও, যদি তারা চায় 
এবং তারপরে মরতে দাও, একের পর এক 
মেঘেরা থোড়াই কেয়ার করে 
তারা কিসের জন্য সেখানে আছে 

এবং তাই তাদের উদ্ধত বাহিনী 
তোমার গোটা জীবনের ওপর 
মসৃণভাবে ভেসে বেড়ায় 
এবং আমার , এখনো অসম্পূর্ণ 

আমরা চলে গেলেও তারা উধাও হবে 
এমন কোনো দায় নেই তাদের 
ভাসমানতায় তাদের দৃশ্যমান 
হবার কোন প্রয়োজন নেই  ।।




এই সংখ্যার কবিঃ মিঠুন চক্রবর্তী, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০


মিঠুন চক্রবর্তীর কবিতা


অপাঠ্য

যখনই শহরে যাই, মনে পড়ে পলিদির কথা। 
আগে গ্রাম ছিল। 
বেখাপ্পা সারল্য সরিয়ে বুকের ঢালু পথে
আজও থেকে গেছে বহমান নদীটি । 

বিকেলের লঞ্চে বাড়ি ফিরি,
চলমান দূরে মানুষের টুকরো টুকরো তৈলচিত্রে
ক্রমশ কালো কালো ছোপ পড়ে আসে.... 

ভাবি, পলিদির সাথে শেষ কবে দেখা... মনে নেই
অজস্র কর্মব্যস্ততার মাঝে একা একলা নদীটিতে
সন্ধের আগে অপাঠ্য লাল লাল ঢেউ ওঠে....

 
 
অসুখ সময়ে

যেন কোন্ অসুখের মধ্যে আছি
ফুলের দিকে তেমন কোনো ফুল দেখিনা,
নদীর দিকে তেমন কোনো নদীও না

চরাচর জুড়ে ধূসর ঘোড়া এক ঘুমিয়ে রয়েছে । 

এইসব কুয়াশা পেরিয়ে কিছু বিলুপ্ত পাখি আসে, 
ঠোঁটে খড়কুটো বয়ে এনে আমার ভেতরে বাসা বাঁধে। 
আমি যেন শহুরে প্রাচীন বটের ভাঙাচুরো ছায়াটি

রোজ রাতে শেকড় থেকে এক বুনো চাঁদ উঠে এসে
একা একা চুপ করে বসে থাকে মাথার উপরে। 


 
 
যে ভালোবেসেছে



ভাবনা জুড়ে স্পর্শ তোমার, আকাশ জুড়ে পথ.... 
ভালোবাসার কাছেই আছে মনে রাখার শপথ

মনের ভেতর সোনালি মাছ, বুকের ভেতর সুখ, 
দখিন হাওয়ায় আলোর পালক এমনি করেই ভাসুক

এমনি করেই দিন কেটে যাক, এমনি করেই রাত
ঝিনুক-মহল সাজিয়ে রাখুক মুক্তো লেখা হাত

হাত ঘুরিয়ে বৃষ্টি নামাও.... হাত ঘুরিয়ে রোদ....
ভালোবাসা মানেই যেন আগুন পেল বারুদ।

আগুন দেখে উৎসাহীরা দেখতে এলে ছাঁই
দেখিয়ে দেবো পলাশ বনে ফুটেছে রোশনাই

 
 
মাঠ এবং ঘুমন্ত চাঁদ

সন্ধের মাঠটিতে ওরা এসে দাঁড়াল।
দু'পাশের গোলপোস্টের কোনোটিতেই তখন 
                            কোনও বিষাদচিহ্ন ঝুলে নেই। 
দাঁড়াতেই ঘাসের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল মেঘ....

শান দেওয়া দু'ফোঁটা বৃষ্টি 
বুকের রোমকূপে কতটা ধারালো হতে পারে
                                           --- বুঝল পুরুষসঙ্গীটি
মেয়েটিও আগে কখনো দ্যাখেনি ,
পাথরের লকলকে জিভে লেগে থাকা নরম স্থাপত্য। 

দূরে দিগন্ত নেই, রাস্তা.... নীল কুয়াশা চিরে 
ঘুমন্ত চাঁদ কোলে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে কাপাসতুলো


আলো


কচি নিমপাতার মত আঙুলে যখন ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছ আমায়
তোমার হাতে রেখেছি আমার দীর্ঘ দিনের না সারা অসুখ

আহা! অসুখও কতখানি মনোরম হতে পারে
জ্যোৎস্না ছুঁয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে ইঁট- খসা প্রাচীন স্থাপত্য

এবং তুমি আঙুল নির্দেশ করে দেখাচ্ছ - 'ওই জানলা.... 
ফাটলে বটগাছ,  ওখানেই তো এসে দাঁড়াত ইন্দুকুমারী
স্নান করে ছড়িয়ে দিত ভেজা লম্বা চুল,  বেল ফুলের গন্ধ

আর, ঐ- ঐ যে দূরে চাঁপাগাছ ওখানে ব্রাহ্মণপুত্র চন্দ্রাহত
রোজ পূজোর ফুল তুলতে এসে সাজিতে ভরে নিত প্রেম... '

এখন আমি তোমার স্পর্শে আমাদমস্তক আলোর উৎসস্থল।

কিছুক্ষণ থেমে, কিছুটা অন্ধকার দেখিয়ে তুমি বলে উঠলে,
'ঐ - ওখানে কালো মোটা বীভৎস লোকটা অত্যন্ত গোপনে
একটা ধারালো অস্ত্র বাতাসে সবেগে এক ঝটকায় ঘুরিয়ে
এসব সুগন্ধি  দৃশ্যে ভারী পর্দা ফেলে নির্বিকার চিত্তে বলেছিল, 
'রাজাদেশ একমাত্র সত্যি, বাকি সবকিছু ভ্রম, সত্যি ভেবো না '

মুচকি হাসলাম আমি, তুমিও বোধহয়

একঝাঁক বয়স্ক নক্ষত্রের নিচে অঙ্কুরিত আলোয় দেখছি,
প্রাচীন উঠোনে বসে হুবহু সবকিছু খাতায় তুলে নিচ্ছে 
সাদা সালোয়ার-কামিজের পাশে হলুদ পাঞ্জাবী পর্যটক 


কবি পরিচিতি: বাঁকুড়া জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম ছাগুলিয়াতে জন্ম এবং বেড়ে ওঠা।ছোটো থেকেই কবিতার প্রতি নিবিড় টান।বর্তমানে বিভিন্ন বাণিজ্যিক পত্র-পত্রিকায় এবং লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত কবিতা প্রকাশিত হয়। পশ্চিম মেদিনীপুরের একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতার সংগে যুক্ত।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : 
১ | যারা এখনও ভিজতে ভালোবাসে
২| যাপন কোলাজ
৩| রাতের কমলা রঙের মেয়েগুলি
৪| নীল প্রজাপতির উপত্যকা
৫| পঞ্চদর্শী ( পাঁচজন কবির কাব্য সংকলন)
 
 

Wednesday 1 July 2020

প্রত্যূষ কর্মকারের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষাসংখ্যা, ২০২০



অপেক্ষা
প্রত্যূষ কর্মকার 

নিভৃত সাঁকোর নীচে যেখানে মূর্তি নদীটি,ক্ষীণ দেহ,
পাথরে পাথরে ক্ষত বিক্ষত,তবুও বহমান,
অনন্ত থেকে নেমে এলে তুমি,হাতে কারু সাজি,
আঁচলে জড়িয়ে আছো আদুরে বাতাস,
তর্জনী ছুঁয়ে আছে প্রিয়মুখ স্নেহ;
বলেছিলে একদিন ধীর চোখে,'যেতে পারি,আপনি যদি যান'-
আজ মূর্তি নদীর মত ম্রিয়মাণ মুখ নিয়ে ছুঁয়ে আছি শ্রান্ত সোপান
কাঞ্চন ফুলে ঢেকে আছে মায়াপথ
গেস্ট হাউসের লনে সন্ধ্যা ঝুঁকে পড়ে নিবিড়ের মগ্নতা নিয়ে
এখানে প্রেম বহে জারুলের গন্ধের মত
এখানেই লিখে রাখি অনন্ত শয়ান

মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প 'শরণাগত' , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০


শরণাগত

মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়

 

কাঁদতে-কাঁদতে পথের ধূলোয় লুটিয়ে পড়েছে সারণ্যা ।

ধম্মপাদের আজ অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে । সারণ্যার পিতামাতা তীর্থ ভ্রমণে গিয়ে আর ফেরেনি । না ফেরার কারণ সকলের অজানা । প্রত্যেকে অনুমান করে নিয়েছে তারা দুজনেই জীবিত নেই । সারণ্যাকে ধম্মপাদের মাতার কাছে রেখে তীর্থে গিয়েছিল সারণ্যার পিতামাতা । তাই ছেলেবেলা থেকে তার আর সারণ্যার একসঙ্গে বেড়ে ওঠা । কত খুনসুটি । কঠিন অসুখে একদিন ধম্মপাদের মাতা এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করল । তখন ধম্মপাদের বয়স নয় ও সারণ্যার সাত ।

সারণ্যার দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ হয়ে ধম্মপাদ তার বেণী ধরবার চেষ্টা করলেই তারস্বরে কান্না জুড়ে দিত । আর তার পিতা পুঁথিতেই চোখ নিবদ্ধ রেখে গম্ভীর স্বরে বলে উঠতেন, ‘সুবোধ ছেলেদের এহেন কর্ম্ম শোভা পায় না ধম্মপাদ ।’ কথাটা শুনেই ধম্মপাদ সংকুচিত হয়ে পড়ত । আর সেই সুযোগে সারণ্যা একছুটে কিছুটা দূরে গিয়ে খিলখিল হাসির শব্দ তুলে বনানীর আড়ালে লুকিয়ে পড়ত । আর রাগে ধম্মপাদ শূন্যে আপন দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ছুঁড়ে দিত ।

আবার সারণ্যা যখন নিজে না খেয়ে পাথরের খোরায় তার জন্য অন্ন সাজিয়ে অপেক্ষা করত, তখন ধম্মপাদের মন সারণ্যার সব দুষ্টুমিকে ক্ষমা করে দিত । পুঁথি অধ্যয়ন করতে-করতে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লে সারণ্যা তার পুঁথি সযত্নে কুঠুরীতে তুলে রেখে তার মাথায় উপাধান দিয়ে দিত । সারণ্যার করুণাময়ী রূপ ধম্মপাদকে তার মাতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতো ।

   আজ ধম্মপাদের অনেক পুরনো কথা স্মরণে আসছে । নাহ্‌, সে আজ অশ্রুপাত করে অন্তর ভারি করবে না । আজ আসক্তি, মায়া, স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়ার স্পৃহাকে সে পরাস্ত করতে পেরেছে । পিতার আর্তি, সারণ্যার কোমল বাহুডোর উপেক্ষা করেছে । মস্তকের উপর নিশ্চিত ছাদ, সম্মুখে সজ্জিত অন্নের মায়া ত্যাগ করে সে আজ পথে বেরিয়েছে । সে আর সংসারজীবনের ক্ষুদ্র মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে পারবে না ।

সারিপুত্র স্বহস্তে তাকে পাঠদান করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একসময়ে সংসারের আসক্তিতে আচ্ছন্ন ধম্মপাদের আজ সংসারকে বিষবৎ লাগে । সে আজ প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে অনন্ত মুক্তির আলো সেই সুকোমল পাদপদ্মে সে নিজেকে সমর্পণ করেছে । কর্ণে দিবানিশি ভেসে আসে ...

“বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি

ধম্মং শরণং গচ্ছামি

সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি ।।”

সুবিৎ ব্যানার্জীর কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০





ভাঙন
সুবিৎ

শোকেরও তো রোমন্থন লাগে।
কতখানি মাটি গেল ঝুপ ঝুপ
গড়ান বানের রাতে,
উঠে দেখতে হয় বারে বার।

বড় মশা ও মাছির উপদ্রব হয় এ সময়।
কাঠের তক্তাপোষ আড় হয়ে দোলে
তিনটে ঠ্যাঙের দাগে।

চন্ডাল ! আলো জ্বালো আগে...
হিম হিম বর্ষার রাত ,
যেকোন কাজে জানোইতো বড় করে আগুন লাগে।

বিপ্র সনাতন গান ধরো ভাই , প্রাণ ভোলে সুরে সুরে
ভোর হবার খানিক আগে।
মাতলা নদীর বাঁক... নেতা ধোপানির ঘাট
সোমত্ত নারীর মত ডাকে , অন্ধকার ফাঁক।

নিজের ছায়ার গায়ে কতক্ষণ হাত বোলানো যায় আর এভাবে!



শুভনীতা মিত্রের কবিতা , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০






আপনজন

শুভনীতা মিত্র 



বাবার কাছে শুনেছি পিসিঠাম্মার গল্প
মাঝেমধ্যেই তিনি চলে আসতেন তার দাদাদের কাছে 

ছোট ভাইপো ভাইঝি দের সোহাগ করতে
না, তার কোন নিজের সন্তান ছিল না
প্রকৃত সঙ্গিনী নাকি তিনি হয়ে উঠতে পারেননি
তার স্থান ছিল মাটিতে চাটাইয়ে
মারধোরের সাথে মিলে যেত কিছুটা খাবার

আবার কিছুদিন পর বলতেন ফিরে যাওয়ার কথা...

মাঝরাতে উঠে বাক্স প‍্যাঁটরা গুছিয়ে
বসে থাকতেন ভোরের আলোর অপেক্ষায়

আসবাবে ঠাসা ঘরে জায়গা হয়েছিল ওঁর
খুব বেশি আলো ঢুকতো না সেখানে
তবু কোন এক ইচ্ছেয় ভর করে তিনি ঠিক 

খুঁজে নিতেন আপনজন

অরূপম মাইতির কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০



মানুষের জামা

 অরূপম মাইতি

সখ করে রঙ বদলে সাধারণ হয়েছিলে...

রোদ্দুর মেখে রাস্তায়, কলে দাঁত ধুয়ে চান

আলুর ধুলোতে বিরক্ত না হয়ে বাজারে

কুলকুল ভেসে যাওয়া তরলে মাখানো

টাটকা বা বাসি, হরেক সবজির গন্ধে

হড়কে না গিয়ে, ভয় পিছনে রেখে শির

অবিচল রেখে বাসের পাদানিতে আঙুল

গিঁথে হাসতে হাসতে অফিস পৌঁছে, লজ্জা

না পেয়ে এক-একটা দিন খরচ করেছ

রঙিন হওয়ার আবদারে সামিল না হয়ে

আঁধারকে ভালবেসে, আম আদমির সব

পেখম-তোলা নাচের দৃশ্যে, নিষ্ঠাবান তুমি

যেভাবে ভূমিকা পালন করেছ, তাতে  

রামধনুর সব রঙ ধার করে দিনগুলো

লেখা হয়েছে আমাদের নামে, এক সাথে

ঠিক যেমন আমি, তুমি এবং অন্য সবাই

মানুষের জামা পরে দিন আর রাত কাটাই

Tuesday 30 June 2020

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০







দুপুরের থালায় নদী

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়


আমরা দুজনেই একটু একটু করে 
খেতে ভুলে যাচ্ছিলাম
তার মানে কিন্তু কখনই এরকম নয়
আমাদের কোনো খিদে ছিল না অথবা
আমরা খাবার চিনতে পারছিলাম না
আমাদের সবই কিন্তু খুব কাছাকাছি ছিল
তবুও খেতে ভুলে যাওয়াটাকে আমরা
জানলা বন্ধের বিপরীত মানে করছিলাম
তাছাড়া খিদেটাকে আমরা দুজনেই 
কেমন যেন কুয়াশা কুয়াশা মনে করতাম
যেন একটা রঙ উঠে যাওয়া কালো পর্দা
সবকিছুর সঙ্গেই জড়ানো আছে

খেতে ভুলে যাওয়ার দ্বিতীয় দিনেই 
আমাদের কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসছিল
আমরা জানলা খুলতে শিখেছিলাম
আকাশকে দেখে এই প্রথম মনে হয়েছিল
ইজেলে টাঙানো ক্যানভাস
পছন্দমতো যেকোনো রঙে ডুবিয়ে
চোখে টাঙিয়ে নেওয়া যায়
সাদা পাতার মতোই আকাশের সামনে দাঁড়িয়ে
মনে হয়েছিল আমাদের বুকে কথার পাহাড়
আমরা শুরু করেছিলাম অনর্গল কথার সংলাপ

একসময় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমাদের চোখ
অনবরত ঘুরপাক খেত এখানে ওখানে
তাকাতেই হবে এমন কোনো বিষয় নয়
তবুও চোখ যেন কিছুর সন্ধানে ফিরতো
গর্তের চারপাশে অগণন মাথার সঙ্গে
কখন যেন আরও দুটো মাথা যোগ হয়ে যেত
তখন তো আমাদের এক পাহাড় খিদে

ঝড়ের তাণ্ডব, অবিরাম ধারাপাতের মধ্যে
চোখগুলোকে কি করে একজায়গায় টেনে আনব
এই নিয়ে আমাদের মনে কিছু এসে জড়ো হয় নি
চোখকে যে একবিন্দুতে এনে ফেলা যায় 
শুধু চোখ দিয়েই পড়ে ফেলা যায় জলের সমগ্র অধ্যায়
বিন্দুতে আমাদের কোনো বিশ্বাস ছিল না
খিদেই তো আমাদের চড়কির মতো ঘোরাতো 
কাজের শেষে সাইকেল নিয়ে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে
বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে দাঁড়িয়ে
আমাদের কোনো আকাশের গল্প ছিল না

জানলা খোলার দিন থেকেই আমাদের সূর্যের গল্প এলো 
বটগাছের পাতায় পাতায় রোদ দেখে মনে হলো
আমরা ভালো করে তাকাতেই শিখি নি
খিদের সঙ্গে সঙ্গে অগণন পোকা
উঠোনে জড়ো হয়ে পৃথিবীর মাটিকে আড়াল করেছিল
আর আমাদের ব্যক্তিগত ইমারতের শোভায়
আমরা ভুলে যাচ্ছিলাম আমাদের দাঁড়ানোর প্রসঙ্গ
এখন বিন্দুর ঔজ্জ্বল্যে আমরা ফিরে পাচ্ছি
নগর সংকীর্তনের ভাষা আর সুর 
পথের দুপাশে সাজানো সবুজ বিন্যাসের সঙ্গে
আমাদের বাপ ঠাকুরদার রক্তের সমীকরণের সাদৃশ্য

প্রতিটি ঘরের কোণেই একটা দুটো তিনটে চারটে
খিদে পরপর শুয়ে থাকে নিজেদের নিয়মে
গায়ে গা লাগিয়ে নয়, খিদের মতোই ছোটো বড় হাঁয়ে
রোদ্দুরে পিঠ দেওয়ার মতো করে মনে হয়
ভিজে লোমগুলো শুকনো হয়ে ফুলে ওঠা দেখে
একটু আগেও ওরা হা-মুখের মধ্যে ডুবে ছিল
ছুঁড়ে দিলেও যারা উড়ে যায় না
ঘুরে ঘুরে ঠিক কোনো পথের মাথায় দেখা হয়ে যায়
তখন আবার সেই শূন্য থেকে শুরু হয়
গোগ্রাসে সবকিছু খেয়ে নেবার প্রাণপণ চেষ্টা

যেদিন বাড়ি থেকে অনেকটা দূর পর্যন্ত 
পায়ে হেঁটে এগিয়ে যেতে পারব
পথের হাজার জিজ্ঞাসাতেও 
আমাদের চোখে ঠিকানা থাকবে না 
দাঁড়াবার জায়গার চারপাশ জুড়ে 
দুপুর পা ছড়িয়ে এসে বসবে
সেদিন দুদিকের দুটো নদীর জলে
আমাদের দুপুরের থালা থই থই করবে ।







তাপসী লাহার কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০






সেলাই

তাপসী লাহা

অনুবাদের গায়ে শব্দ সেলাই করো
পরিতাজ্য চাদরের
ছেড়াটুকু
বিষমের ভার নিয়ে.. ঘ্রাণ ছড়ায়
যেন  আস্তানা ছিল নদীর চোখে।

অজস্র বছরের  ঘুমগুলো,ছেড়া পুঁথি ডুবে আছে
 কত ইতিহাসে। 

বটের চিহ্নে ঝুড়ি মাখা আজগুবি নালিশ
ডাকছি আবার ... কাহ্নর ভুল সব, পুস্তকের পাশে

একজোড়া ডাহুকের অভিসার,কলমি লতায়
হাসিগুলো ঢেউ তোলে,
 হাসতে হাসতে ভুলে যায়
বিজন ঘরের কবি, স্মৃতিতে ধরে রাখা শেষ দুটো লাইন।
পাতার ফোকরের সিঞ্চনের ছন্দগুলো দুঃখ আঁকে
আস্ত একটি শরীর কোথায় খু্ঁজে ফিরি।

  হাওয়ায় নীরব ভিনদেশী কলমের শ্বাস ফুলে ওঠে

  এরই ফাঁকে,  ছিন্ন চাদর উড়ে গিয়ে আটকে             যায়  অচিন বাঁশের ডগায়।



গ্রিক কবি কিরিয়াকা কারসাম্বার কবিতা ,অনুবাদক উজ্জ্বল ঘোষ ,সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা,২০২০





এখন আর

কিরিয়াকি কারসাম্বা

এখন আর কিছুই আশা করি না আমি।
মন দিয়ে শুনি সব।
জীবন সামনে আসে হাজার রূপে:
প্রকৃতি, মানুষ, জীবজন্তু, পাখি,
সুগন্ধী, সূর্য, বৃষ্টি আরও কত কী!

নানা তথ্য, কান্না, হাসি
অপরিচিতের চোখে ঐশ্বরিক ঝলক,
ঘাতক, বিচারকের অপ্রত্যাশিত করুণা,
প্রিয় কিছু চিরতরে হারিয়ে ফেলা,
ব্যাখ্যাতীত ঘটনাসমূহ,
সহযাত্রীর মুখ-ঝামটা—
এ সবই জীবনের ভিন্ন ভিন্ন রূপ।
হীন ও মহান প্রিয় সব মানব,
ভালোবাসা, নৈঃশব্দ্য—
সকলই কড়া নাড়ে জীবনের দ্বারে।



একমাত্র সাক্ষী

কিরিয়াকি কারসাম্বা

সন্দেহ-সংকটের উৎসে পৌঁছাতে
আমাকে সবকিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
নিজেকে যথাযথ সম্মান জানাতে
এছাড়া উপায় ছিল না আর!
যদিও তুমি জানতে, আমিই ছিলাম
সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সাক্ষী, আর
আমাকে ছাড়া শেষ সিদ্ধান্ত
থেকে যেত অধরা।
অন্য কেউ উপলব্ধিই করতে পারবে না
আমার কাছে এই যাত্রা কতটা আত্মমর্যাদার ছিল।


(গ্রন্থ: প্রায় সত্যের মতো উলঙ্গ, আথিনা ২০১৮)

[ কবি পরিচিতি: পেলোপনিসসের (দক্ষিণ গ্রিস) কালামাতা শহরে ১৯৪৬ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি এশিয়া মাইনর (বর্তমানে তুরস্ক) থেকে আগত এক উদ্বাস্তু গ্রিক পরিবারে জন্ম কবি কিরিয়াকি কারসাম্বা-র (Κυριακή Καρσαμπά)। গ্রিসের আরিস্ততেলিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি চিকিৎসা-বিদ্যায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। গত ৩৪ বছর ধরে তিনি চিকিৎসা করে চলেছেন গ্রিসের নানা প্রতিষ্ঠানে। রক্ত-বিজ্ঞান (Hematology) নিয়ে তাঁর লেখা গবেষণা-গ্রন্থ অনূদিত হয়েছে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায়। তাঁর মানুষ তথা জীবন দেখার চোখ স্বভাবতই আমাদের থেকে একটু আলাদা। এসব অভিজ্ঞতার আলোকেই রচিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "প্রায় সত্যের মতো উলঙ্গ" (Σχεδόν Γυμνή Σαν Την Αλήθεια / স্খেদন গিমনি সান তিন আলিথিয়া) প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে।]

Sunday 28 June 2020

মৌপ্রিয়া গাঙ্গুলির কবিতা , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০




অসমাপ্তি
মৌপ্রিয়া গাঙ্গুলি 

না, আমি সত্যি জানি না এ গল্পের সমাপ্তি কোথায়!
আর আমি এও জানি না কেনই বা আমরা পরিসমাপ্তি খুঁজি?
সব গল্প কি সত্যি সমাপ্ত হয়?
এই যে আমাদের মনগড়া গন্তব্যে পৌঁছানোর চিরকালীন আকাঙ্খা,
প্রাক্তনদের বারংবার ঘরে ফিরতে চাওয়া!
আমরা প্রত্যেকেই অন্তিম আবার আমরাই শুভারম্ভ...
গল্পেরা শেষ হতে হতেও হয় না শেষ...
লুকিয়ে বেঁচে থাকা গল্পগুলো আবার নতুন গল্পের প্রাণ সঞ্চার করে!
প্রতিদিন প্রতিনিয়ত তারা পৃথিবীর বুকে পুনর্জন্ম নেয়...
অসমাপ্তির ইতিহাসে তাই আমরা আজও হেঁটে চলি, 
জানি না এ পথের শেষ কোথায়! 


অনুপম দাশশর্মার কবিতা 'জলময় প্রণয়' ,সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০


জলময় প্রণয়

অনুপম দাশশর্মা

অনেকদিন পর বাতাসে জলের সোঁদা গন্ধ ভেসে এলে
শানবাধান পুকুরঘাটের সাবানজল চোখে ভাসে।
অবাধ্য মতি নিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ি একটু দূরে। দেখি 
একঝাঁক সাবানের বুদবুদ ঢেকে দিচ্ছে কায়স্থ পাড়ার 
সেরা সুন্দরীর নিরক্ষর দেহ। ভাষাজ্ঞান ছিল না তার, অথচ
যাবতীয় মণিমুক্তো খচিত বিভাজিকায় সে ধারণ করেছে
শ্রাবণের স্রোতধারা দুর্নিবার আকর্ষলতায় সহাস্যে।

নেমে এসেছে সন্ধের শিথিলতা। ঘাটের পাশে কাশবনে
লেগেছে ভাদরের দরদ। আমি কড়া নিশ্বাসে দমিয়ে রেখেছি বুকের হাপর।
কেউ নেই ধারেকাছে তবুও চকিতে
দৌড়ে যাওয়া কাঠবিড়ালিকে দেখে লুকিয়ে পড়তে চাইছে
সাহসী ডান হাত। নরম ঢেউয়ে হিসহিসিয়ে উঠছে যুবতী।

আমি ক্রমশ বন্দি হয়ে চলেছি বৈধতাহীন প্রণয়কথায়।

মন্দিরা ঘোষের কবিতা 'পৌরাণিক' ,সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০




পৌরাণিক

মন্দিরা  ঘোষ

আমাদের পৌরাণিক মাটির বর্ণমালা,
ফুলের গর্ভচক্র, পাখিদের ঔরস  থেকে
শিখে নিতে হবে জারজ জন্মের ভূমিকা

শিখে নিতে হবে  অনার্য রমণীর  ভাষা
তাদের সুমেরুশিখরে ফুটে থাকা বনের আলো
উদ্ধত পুরুষাঙ্গে শাসনের দাসখত
 
এখনো ডিঙি নৌকার  ঘামে
হেসে ওঠে রঙিন বালিমাছ
চতুরতাহীন জলাশয়ে নেমে আসে
ভোরের মেখলা

ওইসব পাথুরে সমাজের গন্ধ
ইতরের ধুলোস্নান মেখে নিতে
জলীয় বাতাস ডাকো
আদিম আয়োজনে  উল্কির মতো
শিশুদাগ গাঁথো
 
এসবই অন্ত্যজ বিকার ভেবে ফিরিও না চোখ
আমাদের উলঙ্গ বিছানায়  সঙ্গমের
নড়বড়ে সেতু
পেরোতে পেরোতে জন্ম ছিঁড়ে যায়

  আজো খাজুরাহো বেয়ে নেমে যায় দ্রাবিড়ের ঘাম
কুর্চির স্নেহে ডুবে আছে বক্ষজ আঁধার
শিশুর গায়ে সোনালি রোদের জামা
জ্যোৎস্নাঠোঁটে  একা একা  কিশোরী কুড়োয় মেঘ
সমস্ত নক্ষত্র  বুকে  রাত রাত সাহসী পুরুষ
দূরে ফসলের আলোয় ডুবে আছে
ঘরনীর সাধ

এসবই নৈমিত্তিক প্রলয়ের  রং
এ বৈদিক  ঘুম ভেঙে গেলে
যজ্ঞঘরে খাক হোক মহাবৃত্তের কূটখতিয়ান

অরণ্যা সরকারের কবিতা , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০



অরণ্যা সরকারের কবিতা


বর্ষা সংখ্যার কবিতা

 

কিছুই সহজ করে নয়

চলে যাওয়া নিয়ে, ফুরোনো নিয়ে, নিরাময়  নিয়ে

এই যে আয়না বসানো, ঘাড় ধরে দাঁড় করিয়ে দেওয়া 

সবই প্রকল্প অধীন

ক্রীতদাসদের স্বপ্ন থেকে ছিটকে আসা ফুলকি

যতবার ফলনের গল্পে নিয়ে যায়

ইঁদুরের অভিজ্ঞ গর্ত থেকে উঠে আসে  গোয়েন্দা দৃষ্টির সিলেবাস

ফুল সেদ্ধ করতে করতে খুঁজি ক্যাচলাইন

পাখি কিনি, ঘরে ফিরি, বাগান করি

কদম, আহা কদমবলে নিভৃত সাজাই

বৃষ্টির কুহক লিখবো ভাবতেই

তথ্যসূত্র হাতে এসে দাঁড়ায় আবহদপ্তর


নেই

 

কাদা প্যাচপ্যাচ স্কুল রাস্তায় সেই কবে

হারিয়ে গেছে ভেজা পেন্সিল

একটানা স্নানে গাছেদের সর্দিলাগা দিন,

কচুপাতায় ঢাকা মাথা, ছিটকাপড়ের ফ্রকে

কাদার বন্দিশ নিয়ে চলে গেছে শ্রাবণসংকেত

চলতহি অঙ্গুলি চাপিসে আমার রাধিকাবসত

শুকনো দোপাট্টায় মুছে রাখে ডানার ব্যাকরণ

মেঘ শুধু সূর্যের না ওঠা, ভ্যাপসা গৃহস্থালি

এই আমি ইচ্ছেমত একান্ন টুকরোয় বাঁচি

তোয়াক্কা করি না

মেনোপজে লকেট করি অ্যাণ্টিক উর্বরতা

বাতিল সেফটিপিনে শুধু কিছু অভিমান

সেইসব থৈথৈ এর দিব্যি

শ্যামশ্রী, আর কোন বর্ষাম্যাজিক নেই

 

কেকা সেনের গল্প 'জলছবি' , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০






জলছবি
                কেকা সেন                

--- মা, আর একটু ভাত দিবি? খুব ক্ষিদে পেইচে রে?
লকাই এর কথায় সুবলা হাঁড়ির ভিতর চোখ পাতে। তলায় যেটুকু ভাত পড়ে আছে, সবটুকু দিয়ে দেয়। 
মনে মনে বলে -- খা বাপ, পেট পুরে খা...
তিনদিন ধরে অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি রানী। আল বাঁধানো নোনা দেহে যেন জল-তরঙ্গের লহর। গত দুইদিন সুবলা নদীতে মীন ধরতে গেছিল। আজ আর যায়নি।শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে তার। নয়তো সেই কবে থেকে এই কাজ করছে সুবলা...হাতে পায়ে হাজা ধরা গতরটা এবার যেন বড্ড কাবু হয়েছে! আজ বড্ড বেশী করে নারান এর কথা মনে পড়ছে সুবলার। নারান... তার ভাতার...যেদিন সেই কালো পাহাড়ের মত সুঠাম দেহটা নদীর পেটে তলিয়ে গেল, তখনও এমন একটানা বৃষ্টি ছিল, বাঁধ-ভাঙ্গা বৃষ্টি।

---- মা জানিস ওই মুখুজ্যে বাড়িতে আবার লোক এইচে।

পলকে তাকায় সুবলা।

--- তুই যাসনি তো আবার ওদের ওখ্যানে?

-- না মা, তুই তো বারন করে দিইচিস!

 চোখ দুটো জ্বলে ওঠে সুবলার

-- আচ্ছা মা, বাবা বুঝি ওদের জমিতেই লাঙল দিত?
-- হ্যাঁ বাপ।
-- ওরা তো এখান থ্যাকি চলি গেইল, তবে?

হ্যাঁ মুখুজ্যেরা তো কয়েক বছর আগেই এখানকার পাততারি গুটিয়ে কোলকাতায় চলে গেছে।  অন্তত সুবলা তো তাই জানে। তবে কিএমন হল যে আবার এক্যানে-- মনে ভাবে সে। 
  
মাইকে সমানে হেঁকে চলেছে, আরও দুদিন বৃষ্টির আভাস। সবাইকে বড় ইস্কুলবাড়িতে উঠে যেতে বলছে।নদীর বাঁধন এবারও বুঝি আর থাকবে না। ক্রমশ জনপথে এগোন নদী যেন ভাঙ্গা -গড়ার জীবন রথের জলছবি। একটা কাপড়ের পুটলি আর লকাইকে নিয়ে সুবলা ইস্কুলবাড়িতে উঠে আসে। পাশে বসা সাদা কাপড়ের মুখখানা বড্ড চেনা ঠেকে তার। পাশের সাদা কাপড়ও করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। মুখুজ্যে গিন্নি! 

--- ছেলেরা, কর্তামশাই মারা যাওয়ার পর আবার এখানে পাঠিয়ে দিলে গো বউ।

পাংশু মুখের শীর্ণ বৃদ্ধাকে দেখে সুবলার দয়াই হল।

---- কিছু খ্যায়েছেন বামুনমা।

বৃদ্ধা দুপাশে মাথা নাড়ে। সুবলা তার পুঁটলির ভিতর থেকে  দুটো মুড়ির মোয়া বার করে হাতে দেয়। বৃদ্ধার চোখের কোনে জল দেখে মুখ ঘুরিয়ে নেয় সে। মনে মনে ভাবে -- সেদিন আমাদের মত ছোট জাতকে এট্টু আচরয় দ্যালি, আমার নারানকে বাঁধ ভাঙ্গা জলি ডুবতি হতনি বামুনদি!

কলকল শব্দে নদীর জল এখন অন্যদিকে বইছে।