পাঠ প্রতিক্রিয়া
কালপুরুষের তরবারি
অমিত সরকার
আমি জানি কবিতা কোনোদিন পৃথিবীর মুখ বদলে দিতে
পারবে না। তবু প্রতিদিন ভোরবেলা যাপিত
কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ব্যালকনি থেকে আমি
দেখি, অদ্ভুত এক
আন্দোলনমুখর নীরবতার মধ্যে দিয়ে একা হেঁটে আসছে আমাদের বাংলা কবিতা। বিষণ্ণ কালিমাখা এবং কুয়াশাচ্ছন্ন এক আঁধার ঢেকে রেখেছে তার স্বাভাবিক
হ্যালো। এই মুহূর্তে শঙ্খ ঘোষ বয়েসের ভারে নীরব, অলোকরঞ্জন সদ্য চলে গেলেন না
ফেরার দেশে, জয় আর অতীতের মত স্বর্ণপ্রসবিনী নন, দেবদাস আচার্য বা সুব্রত সরকারও ইদানীং সেভাবে আর প্রবল উপস্থিতিময় নন, তাহলে বাঙলা কবিতা এখন কোন
টাইটানদের দিকে তাকিয়ে বিমুগ্ধ হবে ?
এইসব ভাবনামুহূর্তে আমি কখনো কখনো কবি সুধীর দত্তের
কবিতাবইতে মুখ গুঁজি। মনে করি আমার প্রতি স্নেহপ্রবণ একজন
খর্বকায় আদ্যন্ত বাঙালি পুরুষের কথা। তাঁকে দেখলেই আমার মনে পড়ে, যেন মধ্যযুগের
কোনো ডাচ মাস্টারের আঁকা ছবি, হয়তো যিনি অনেকক্ষণ একাকী হেঁটে আসছেন পৌরাণিকতার দীর্ঘ রেশমপথ ধরে ধরে। চোখ দুটিতে খেলা করছে এক গভীর
আধ্যাত্মিক অনুভুতিমালা। অন্তরের আলোয় উদ্ভাসিত একজন পুরুষ, যিনি পড়তে পারেন প্রকৃতির
নির্জন গূঢ় শষ্পলিপি। আত্মোপলব্ধি ও আত্মজিজ্ঞাসা যাকে করেছে সকলের চেয়ে আলাদা। যার কবিতার গোধূলি শুধু রংরেখ নয়, সেখানে লেগে আছে দার্শনিকতার এক দিব্য গৈরিক আভা। সেভাবেই আমি আজ হাতে তুলে নিয়েছি তাঁর সাম্প্রতিকতম সৃষ্টি “অথ লীলাবতী কথা”
। যেখানে তাঁর কাব্যদর্শনের কেন্দ্রকোরক হল বিশুদ্ধতা। যেখানে গণিত আর পুরাণ, দর্শন আর যাপন যুক্ত হয়ে আছে এক অন্তরতম তরঙ্গদৈর্ঘ্যে । সেই সংহত ভাবনাবিশ্বের যুক্তি যেখানে বদলে দিচ্ছে সময়প্রাচীন বাংলা কবিতার এযাবত লুসিড গতিপথ। ‘বাক’-এর অসামান্য সৌন্দর্যকে তুলে আনছে চোখের পাতায়, কিন্তু কোন ইউটোপিয়ার মধ্যে দিয়ে নয়, বরং ডিসটোপিয়ার এক মারাত্মক Vision-এ। ‘ভিশন’ এই কথাটির কোন সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ সম্ভবত হয় না। এই কবিতাবইতে তাঁর ভিশন বা স্বপ্নভাবনা আমাদের পৌঁছে দিচ্ছে শাব্দিক যুক্তির এক লজিক্যাল ডিসকোর্সের উত্তরণে, যাকে কিটসের কয়েনেজ ধার করে আমি হয়তো বলতে পারি “Egotistical sublime” । এর মধ্যে যে মৃদু ভর্ৎসনা মিশে আছে, তাই হয়তো কবি সুধীর দত্তের কালপুরুষের তরবারি, বাংলা কবিতার প্রতি এক প্রাকৃত বার্তা।
বৈদিক ঋষি উবাচ, ‘মানুষের মধ্যে তাপরূপে যে অগ্নি রয়েছেন, তাঁকে ফুটিয়ে তুলতে হবে জ্যোতিরূপে। এবং সেই জ্যোতি এক হয়ে যাবে দ্যুলোকের অগ্নি আদিত্যের সঙ্গে। তখন ‘দেহসারসৌ পুরুষঃ সোহহস্মি’। কবির এই বৃহৎ হওয়াই সম্ভবত প্রকৃত কবিতা হয়ে ওঠা। হ্যাঁ, একজন কবিই তো নিজে প্রকৃত একটি কবিতা হয়ে ওঠেন যখন তিনি ভূমায় দর্শন করছেন “নড়ে উঠছে শঙ্খিনি বাক।” কে এই বাক ? তিনিই
বেদসমূহের মাতা, ঐতরেয় আরণ্যকে ইন্দ্রের সঙ্গিনী হিসেবে তাঁর উজ্জ্বল
পরিচিতি, আবার
পরবর্তীতে তিনিই পরিগণিত হবেন দেবী সরস্বতী রূপে। কবি কি নিজেই তবে শব্দের আদিপিতা ? কারণ মিথ বলছে শুরুতে তো ছিল সেই বিগ ব্যাং যা
প্রকৃতপক্ষে এক ধ্বনি মাত্র। তাকে চেনার এই প্রজ্ঞাপারমিত সিদ্ধিই কি আজ কবিকে আয়ুর শেষ যামে ইন্দ্র
বানিয়েছে ? তিনি
রূপমুগ্ধতায় তাই দেখছেন, সেই প্রণম্য শঙ্খিনীর নগ্ন মসৃণ উরু, অমর্ত্য
নিতম্ব, শ্রোণীভার। তবে কি তিনিই ঋষি অথর্বান, যিনি অসীম প্রতিস্পর্ধায় উচ্চারণ করবেন ‘শব্দেরা হোক কবির সমিধ’ ?
তিনিই কি বিনিয়োগ
করবেন শব্দকে, আর নিজে ক্রমশ হয়ে উঠবেন ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী
?
আমার মুগ্ধপাঠে এভাবেই শুরু হয় তাঁর “অথ লীলাবতী কথা” নামে কৃশকায় কবিতাবইটি, যার প্রথম কবিতাটির নাম ‘শঙ্খিনী বাক’। আমি জানি কবিও প্রতিদিনের বাস্তবতার
খণ্ডগ্রাসে আমূল আক্রান্ত একজন। জীবিকা ও সংসারের আদিক্ষেত্র পেরিয়ে দূরবর্তী কোন পাড়াগাঁর হাটে তাঁর
নিয়মিত ফিরে আসা এবং যাওয়া। তবু এই খণ্ড খণ্ড মৌহুর্তিক জীবনের
সেতুগুলি যখন নড়ে ওঠে তখনই আমরা বুঝতে পারি বিশ্বপ্রকৃতির
সঙ্গে তাঁর ও আমাদের প্রকৃত সঙ্গঠনার বর্ণমালা। আগে এই অদৃশ্য সেতুসমুহ, যাতে মানুষ জুড়ে থাকত প্রকৃতি বা সমাজের সঙ্গে, তাকে সকলের উপযোগী করে সৃষ্টি করতেন যিনি, তাঁকেই আমরা বলতাম কবি। সেই কবেকার সরস্বতী সভ্যতার যুগে
বাস্তবের পাশাপাশি এক সমান্তরাল ও পরিপূর্ণ জগত সৃজন করতেন তাঁরা। আমাদের সমস্ত খণ্ড অভিজ্ঞতার ডাইনামিক্স জুড়ে জুড়ে অন্য টাইম স্পেস বা
দেশকালের এক বিচিত্র পরিসর নির্মিত হত। পাঠকের মনের মধ্যে সেইসব মহাকব্যিক বিনির্মাণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবার
বদলে নিত নিজেদের। থাকত চিরপ্রাসঙ্গিক। কবিরা তাই তখন স্বপরিচয়েই ছিলেন ঋষি। কিন্তু সময়ের নিজস্ব ডিসকোর্সে আজ খণ্ডচিত্রেরই প্রাধান্য। তাৎক্ষনিকতার কোলাজ এখন ভাবতে শেখায় কবিতা কতকগুলি মুহূর্তের সমষ্টি
মাত্র। যে মুহূর্তগুলির মধ্যে আসলে কোন
যোগাযোগই নেই। সত্যিই কি নেই ? তবে কেন কবি লিখবেন
“গত জন্মের জমিয়ে রাখা আকাশ। কান্না হয়ে ঝরছে মেঘ-
ভিজে যাচ্ছে সারাটা চাতাল।
তোমার চোখের জলে লবণ নেই, তবু শব্দরা কিরকম
জ’রে যাচ্ছে ক্রমশ। ভিতর থেকে উঠে আসছে গোটা একটা
নক্ষত্রনগর।
চলো, আমরা আর একবার তাঁকে বলি, এই তো ছোট্ট একটি
চাওয়া-
বাড়ি ফিরব,
আমার এই নির্বাসন আর ভালো লাগছে না।” - “আর এক দুধপথের দিকে”
কী সরল ও মহৎ এই উচ্চারণ, যার সামনে আজও নতজানু হয়ে বসতে
হয় যেকোন অমেয় সভ্যতাকে। “শব্দেরা জ’রে যাচ্ছে”। “জ’রে”
এই শব্দটিতে কী প্রাচীন, কী বাঙালি এক
মায়া লেগে। লেগে আছে যেন কোন গ্রাম্য ঠাকুমার
বৈকালিক ডাক। এই অদ্ভুত জারণবিন্দুকে স্পর্শ
করে আমার মনে পড়ছে ‘রবিঠাকুরের
কপালে জলপটির মত নরম আঙুলের’ কথা। অথচ কবি জানেন ‘এই যে আলো দেখছ, যা এই পৃথিবীতে সবে পৌঁছল/ সে তারাটি বহু আগেই
মারা গেছে।’ এক জন্ম থেকে অন্য জন্মে এই যে
পরিভ্রমণ, সে কী শুধু মিল্কিওয়ে ধরে ধরে ? অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের মধ্যে ঋষি রমনের মায়াবাদে ? নাকি এটি রোমানটিসিজমের এক অভিনব পুনর্জন্ম, যেখানে “ Ultimately it brings us back to the highway-only at
a greater evolution. We seek it first in
the thunder and the earthquake of fantastic and bizzare. And find it after all
in the small voice of everyday life”.
“ডাউকি নদী বরাবর ওই যে জাফলং, কেয়া ঝাড়,
তারই খুব গা ঘেঁষে তোমাদের গাঁ ?
ইচ্ছে হয় যাই।
একবার ছুঁয়ে আসি ঊরুসন্ধির মত দ্বীপভূমি।
তুমি কি ওখানে থাক ? শীতদেশ ? অন্ধকার ঝুপ করে নেমে
আসে ? আর তুমি একা
উঠোনে ছড়িয়ে হাঁটু, কিম্বা তুলসীতলায় খঞ্জনি
বাজাও আজও ?
স্বপ্নের পুরুষ আসবেন ?” – “পর্ণছায়ায়”
আসলে হয়ত যা সহজ তাই সবচেয়ে সুন্দর। আর তার অভিঘাত যদি বেগপ্রবণ হয়, তাহলে তার হৃদয়গ্রাহ্যতা অনেক
বেশি দ্যুতিময় হয়ে
ওঠে। কারণ আমরা তো জানি জীবন যতটুকু কেড়ে নেয়, দেয় তারও চেয়ে কিছু বেশি। আর এই জীবনপথের সামান্য সেই পাওয়াটুকু নিয়ে এগোতে এগোতে নিজেকেই ভালোবেসে ফেলে মানুষ । তৈরি হয় আবার কিছু পাওয়ার,
হয়তো নিজেকে প্রস্তুত করে দেওয়ার জন্যেও।
আর একটি গভীর উচ্চারণ আমি ছুঁয়ে দেখি, নাম “আদি পুরাণের গল্প”
‘নক্ষত্রের মৃত্যু আর আমাদের জন্মকথা লেখা হবে বলে
আমি তো শূন্যের দিকে সাদা খাতা বাড়িয়ে রেখেছি ।
সম্ভাব্যতার কোন সূত্র ছিল?
লিখো,
হাজার এক ভাবে যার প্রথম পৃষ্ঠাটি
শুরু হতে পারত, লিখো
সেই আদি পুরাণের গল্প,
যেমন বুকের দুধ, গর্ভ কাঠামো,
রামের জন্মেরও আগে যে রকম রামায়নী গান আর লব-কুশ,
আমরা কুশীলব, তুমি কবি,
আমার অবশ হাত তোমার হাতেই রাখা আছে’
ঈশ্বরের কাছ থেকে আসার মুহূর্তে যে আলো আমাদের চোখে লেগে থাকে, তা বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে বুঝি ক্ষীণ, ক্ষীণতর হতে থাকে। তাকে পুনরুদ্ধার করে আনে এক নির্জন স্মৃতি। সেই বুঝি উত্তরণ। সেখানে সময় আর দেশ অর্থাৎ টাইম অ্যান্ড স্পেসের অবস্থান ক্রমাগত পাল্টে যায়। বিজ্ঞান তাকে সংজ্ঞায়িত করে ‘ব্ল্যাক হোল’ বলে। তবে কী কবি এখানে পাঠককে জুড়ে রেখেছেন সেই ভাবনায় ? সেই কৃষ্ণগহ্বর তো সত্যিই এক সম্ভাব্যতার শিল্পমাত্র। যে এক আগ্নেয়গুহায় ধারণ করে রেখেছে মিথ ও ডিমিথ, এক রহস্যমেদুর স্মৃতি ও জন্মের সংকেতরহস্য। সেখানে বারবার পাল্টে যাচ্ছে কুশীলব অর্থাৎ পাঠক, এবং কবি অর্থাৎ স্রষ্টার ভূমিকা। আমার ব্যক্তিগত অনুভুতিমালা বলে এই চিন্তনপৃথিবীর গভীর গভীরতর স্তরে জেগে আছে দুটি উল্লম্ব প্রতীক, যার প্রথমটি নিশ্চিতভাবে ‘শব্দ’। যা বহন করছে মানুষের সফল অসফল সমস্ত অভিজ্ঞতা, চেতনা ও দ্বন্দের সারমর্ম, এবং দ্বিতীয়টি হল ‘কবি’ যিনি ধারণ ও ব্যাখ্যা করছেন সেই সারমর্মের। সুধীরদার কবিতায় এই দুটি ধারণা, বারবার যেন প্রতীক অতিক্রম করে এক স্বাধীন স্বত্ত্বায় ডানা মেলছে। হয়ে উঠছে এক নিরপেক্ষ যত্নে গুছিয়ে রাখা মায়াবাদ। এক অখণ্ড ও প্রবহমান বিশ্বাসের ভরকেন্দ্র। যেখানে সত্যের বাহক ‘শব্দ’ এবং সত্যের ব্যাখ্যাতা ‘কবি’ , যিনি ঋষিও।
আর একটি কবিতায় ঘুরে আসা যাক
“যেন এক কিউবিক মোড়”
“কোথ্থেকে যে উঠে যাচ্ছে, পতনের দিকে কোন সিঁড়ি
চকিতেই বেঁকে যায়,”
শুরুতেই চলে আসছি এখানে দেওয়া M,C. Escher
(১৭ জুন ১৮৯৮ - ২৭ মার্চ ১৯৭২) নামে এদেশের কবিদের কাছে স্বল্প পরিচিত একজন ডাচ শিল্পীর একটি বিখ্যাত ছবিতে। এশার একজন ডাচ গ্রাফিক শিল্পী যিনি গাণিতিকভাবে
অনুপ্রাণিত অসংখ্য উডকাট, লিথোগ্রাফ এবং মেজোটিন্টস এর এক অমর স্রষ্টা। বিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়
হওয়া সত্ত্বেও, এসার ও তাঁর শিল্প নেদারল্যান্ডসের শিল্প জগতেও দীর্ঘকাল খানিকটা অবহেলিত ছিল। তাঁর যে কোন কাজের বিশিষ্টতা এতটাই, যে সেখানে গাণিতিক
অবজেক্ট এবং অপারেশন বৈশিষ্ট্য নির্মাণ করে এক অসম্ভব অবজেক্টিভ বিশ্ব,
যেখানে অনন্তের অন্বেষণ,
প্রতিবিম্ব, প্রতিসাম্য, ও পারস্পেকটিভ জ্যামিতির বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা একইসঙ্গে ঘটে চলে। বিজ্ঞান জানা বা প্রযুক্তিআনন্দিত মানসের কাছে তাঁর ছবি
এক গহীন ভাবনাবিশ্বের খনিস্বরূপ।
এই কবিতাটির নাম এবং প্রথম লাইনের অভিঘাত হয়তো কোন কোন পাঠককে মনে করাবে গগন ঠাকুরের সেই আশ্চর্য সাদাকালো
ছবিদের, যাদের শিল্পকে ব্যকরণ সম্মত
নাম CHIAROSCURO ( এর সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ আমার
অজ্ঞাত) দিয়ে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু পাঠকে পাঠকে তো দীক্ষায় ও নিরীক্ষায় বিনির্মাণভেদ অতি স্বাভাবিক। তাই আমার কাছে এই সিঁড়ির উল্লেখ নিয়ে আসে এক ম্যাজিক রিয়ালিজম। আমি যাকে বলতেই পারি “An enigma behind an illusion”। এখানেও সেই সময় পরিভ্রমণ। প্লেটোর উল্লেখ। ( কি আশ্চর্য, এশারের মুখমণ্ডলের সঙ্গে কি আমি
তাঁর কোন মিল খুঁজে পাচ্ছি
?) তাঁর সঙ্গে কী আমার
দেখা হবে একটি কিউবিক পাতালের মোড়ে। সেখানেই
তাঁর গার্হপত্য। এই দুর্লভপুর, উখড়াডিহি হয়ে অমরক্যাননের
রাস্তায় আমিও তো কতবার ভ্রমণ করেছি বাস্তবেই। তবে কী স্বয়ং ঈশ্বরই লিখে রেখেছিলেন এখানে “ নিন্যা বচাংসি ”।
“আমরাও বিশুদ্ধ হই, যখন শুকতারা শুধু জাগে,
কথা বলি গণিত ও গননাতীতের,
আর এই নির্জনতম ক্ষণে দূরবর্তী দ্বীপের মতন
ছায়াপথ---“ ‘অথ লীলাবতীকথা’
কবিতাবইয়ের এই নাম কবিতাটি কবি উৎসর্গ করেছেন গণিতবিদ শ্রীনিবাস রামানুজমকে। (এখানে প্রকাশ থাকুক গণিতবিদ দ্বিতীয় ভাস্করাচার্য এগারোশ সালে রচনা করেছিলেন ‘লীলাবতী’ নামের এই গ্রন্থ, তাঁর কন্যকার নামে। প্রকৃতপক্ষে ‘সিদ্ধান্ত শিরোমণি’ মহাগ্রন্থের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের নামই লীলাবতী )।
গণিত আসলে কী ? এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যেতে পারে সক্রেটিসের
ব্যাখ্যা ধার করে। গ্রিক দার্শনিকের দাবি, পূজারিণী
দিয়োতিমা মানুষকে দীক্ষা দেন বাসনা-মন্ত্রে। বাসনা বিবিধ। শারীরিক কাম চেতনা
সবচেয়ে নিম্ন শ্রেণির বাসনা। আর সর্বোচ্চ লিপ্সা হল গণিত। যা কেবল সুন্দরের
সন্ধানী। দিয়োতিমার আশীর্বাদে যারা খুঁজে পায় প্রিয়তম সুন্দরকে, তারা মজে প্রজনন লিপ্সায়। জৈবিক প্রজনন নয়, মনীষা-জাত সৃজন। সক্রেটিসের ব্যাখ্যা পরোক্ষে
সমর্থন করেছেন দার্শনিক আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেড। যিনি গণিতকে বলেছেন, ‘মানবাত্মার শ্রেষ্ঠ মৌলিক সৃষ্টি’। আর হোয়াইটহেড-এর
বন্ধু বার্ট্রান্ড রাসেল ? তিনি আত্মজীবনীতে
জানান, গণিতে গভীরতর জ্ঞানার্জনের আকাঙ্ক্ষাতেই
কেবল তিনি বিরত হয়েছিলেন আত্মহত্যা থেকে। তাঁর মতে শাস্ত্রটা যেন এক ভাস্কর্য—
‘শীতল এবং শুদ্ধ... গূঢ় মাত্রায় পবিত্র, কড়া
মাপে সর্বাঙ্গসুন্দর’।
গণিত কেন সুন্দর? ব্যাখ্যা দিতে গণিতজ্ঞেরা উদাহরণ টানেন সংগীতের। বিবিধ বিচিত্র সুর আর
ঝংকারের সমন্বয়ে যেমন শ্রবণের ঐন্দ্রজালিক মাধুর্য, গণিতও তেমনই এক ব্যাপার। নানা উপাদান, একটির সঙ্গে অন্যটি আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কহীন, অথচ যুক্তির সুতোয় গাঁথলে দেখা যাবে তারা এক
অতীন্দ্রিয় অথচ অনিবার্য সম্পর্কে লিপ্ত। ওই সম্পর্কের আবিষ্কার গণিতচর্চাকে বানায়
সৃজনশিল্প।
“আ ম্যাথমেটিশিয়ান’স অ্যাপোলজি”-তে হার্ডির
ঘোষণা, ‘গণিতে আমার আগ্রহ কেবল তার সৃজনশিল্পে।’
তাঁর মতে, চিত্রশিল্পী বা কবির মতো গণিতজ্ঞেরও উদ্দেশ্য প্যাটার্ন বা
বিন্যাস রচনা। ওঁরা বিন্যাস গড়েন রং বা শব্দের সমন্বয়ে, আর গণিতজ্ঞ তা গড়েন নানা রকম ভাবনা দিয়ে। ওঁদের
তুলনায় গণিতজ্ঞের তৈরি বিন্যাস যে বেশি স্থায়ী, তার কারণ সে বিন্যাসের উপাদান হল ভাবনা। তা সে যা-ই হোক, গণিতজ্ঞের রচিত বিন্যাস, চিত্রশিল্পী বা কবির সৃষ্টির মতো, সু্ন্দর হতে বাধ্য। রং বা শব্দের মতো ভাবনাগুলিকেও
সুসংবদ্ধ হতে হবে। গণিতের প্রথম পরীক্ষা তার সৌন্দর্যে। সুন্দর না হলে এ জগতে তার
আসন পাকা নয়।
“অথ লীলাবতী কথা” বা এই
বইয়ের বিভাব কবিতার অন্তরতম বোধিতে আমি খুঁজে পাচ্ছি একই ভাবনার আরোহী, অবরোহী ? তাই তো সুধীর যখন লিখছেন,
“তোমাকে ছোঁয়ার জন্য হে
অনিশ্চয়তা,
হৃদয় আঁকপাঁক করে, আর সে
কম্পন
আপাতালস্বর্গ ঢুঁড়ে নিয়ে
আসে বেশ্যামাটি, কিছু খড়, তনহা ও বিষাদ।”
দীক্ষিত
পাঠক এই কবিতার টানা ও পোড়েনে নিজেকে বিনির্মিত করছে বারবার। লীলাবতী তার কাছে হয়ে
উঠছে শুদ্ধতম গণিতের এক বাকপ্রতিমা, যার সঙ্গে
মিলনের জন্য ছটফট করছে তার বোধের অনন্ত। আমাদের চকিতে মনে পড়ে যায় প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের কথা। মহাযান বৌদ্ধধর্মের অন্যতম প্রধান সূত্র এই প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র। এই সূত্র বলে যে প্রজ্ঞাপারমিতার
সাথে মিলিত হতে হতে বুদ্ধ বুঝেছিলেন জীবনের অসারতার কথা আর তারপরই তিনি প্রকৃত বুদ্ধ হয়ে ওঠেন।
তাই কি এই
গভীর ছটফটানি ? লীলাবতীর সঙ্গে মিলিত হবার
জন্যে এই আকাঙ্খাবাস্পের বিস্ফোরণ। নিশ্চিত সেই কারনেই কবি লেখেন,
“লীলাবতী ছাড়া আমি এক দণ্ডও বাঁচব না মা,
এমনকী যদি
উপড়ে ফেল গ্রহটিকে,”
কিছু কিছু কবিতার কোন ব্যাখ্যা হয় না। হয় না কিছু অনুভূতি বা গ্রহভারের। হওয়া উচিতও নয়। তবে হয় না বলেই
“খণ্ডিত বিবাহরেখা জানতেন আচার্য-পিতা
লীলাবতী,
প্রিয় লীলাবতী!
তোমাকে ছুঁয়েছে এই হাত, যে হাত প্রলয় লেখে, অমরতা লেখে।”
কবির দৃষ্টিতে এই লীলাবতী একজন ‘দ্বা সুপর্ণা’ । অথবা পুরাণোক্ত দ্বিঠোঁট এক পাখি যার এক ঠোঁটে জীবন, অন্য ঠোঁটে ধরা আছে মৃত্যুফল । তিনি দেখছেন তার নাভির নীচের আগুন, তাঁর কাছে সে একদিকে শরীরবীজ নিয়ে দামাল প্রাকৃতিক বহ্নি, অন্যদিকে সেই ঈশ্বরের হস্তাক্ষর। জীবনের গূঢ়লেখ। গোধূলিসন্ধির নৃত্যকলার মধ্যে ফুটে উঠছে তার আকাশভ্রমণ। সেই
স্বয়ং কবি ও কবিতা হয়ে জ্বলে উঠছে ভাসমান সময়সমুদ্রে।
এখানে জীবনের গাণিতিক বিপ্রতীপ হয়ে জ্বলে উঠছে এক ‘ধুলপরিমাণ নূর’ । প্রশ্ন জাগে, কেন ধূলপরিমাণ ? সে কি এই ধুলোমাটি নির্মিত শরীরের সহবাসকথা বলে ? নাকি সেই স্বয়ং Limit theorem, যেখানে শত চেষ্টাতেও মেটানো যাবে না অপরিমেয়কে, জেগে থাকবে ঈশ্বর বা গণিতের সেই অপরিমাপযোগ্য দৈব ব্যর্থতা। নাকি এটাই সেই নিয়ম সেখানে সংকেত পাঠায় সময় ও শরীর, অথবা কসমিক ধুলো। কবি জানেন এই সংকেতে সাড়া দিতে তিনি বাধ্য ।
‘কেননা আয়ুও স্বল্প, অতিজীবনের
জন্য মাত্র কটি দিন, সমান্তরাল পড়ে আছে।’
অথ লীলাবতী কথা / সুধীর দত্ত
সিগনেট প্রেস