Sunday 19 November 2017

সাহিত্য এখন, নভেম্বর দ্বিতীয় পক্ষ,২০১৭






সম্পাদকীয়

সাহিত্য কত ভাবে প্রতিনিয়ত আমাদের মনের জানলায় কড়া নেড়ে যাচ্ছে। ডাক দিয়ে বলে যাচ্ছে, "এস, আমাকে গ্রহণ কর। আমিই বলতে পারি মুক্তির পথ"। সাহিত্য তো কেবল বিনোদন নয়, সে এক অমিত ক্ষমতাশালী কারিগর। শুধু নিখুঁত সমাজচিত্র আঁকাই তার কাজ নয়, সে আমাদের হাত ধরে নিয়ে আসে নতুন উত্থানের সিঁড়িপথে ।
'সাহিত্য এখন' এর প্রথম সংখ্যায় আপনাদের কাছে যে উৎসাহ পেয়েছি, তা আমাদের ভবিষ্যতের পথকে আরও মসৃণ করে তুলবে, সেই আশা রাখি। প্রতিটি সংখ্যাকে আপনাদের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে বারবার হাত পাতব আপনাদের কাছেই। আমাদের সমবেত পথচলা মসৃণ হোক। ভাল থাকবেন। 

গল্প

  হেমন্তিকা 
  পারমিতা মালী

        "হেমন্ত বুড়ো তুমি ভারি পাজী জান? ..কত কি যে মনে করিয়ে দাও তোমার এই হালকা কুয়াশার চাদরের তলায়। তোমার এই মিঠে রোদ ,এই সামান্য শিরশিরানি হাওয়া বড্ড বেশী স্মৃতিকাতর। "
      "তাই বুঝি? তা আমি কি শুধুই খারাপ? আমার ভালো কিছু নেই বুঝি? "
      "আমি কি তাই বললাম ? ..তুমি খারাপ হতে যাবে কেন? ..কিন্তু তুমি বড় মনকেমন ..
      "মনকেমন হলে বুঝি তোমার ভালো লাগে না? "
    "কি জানি ছাই! !!! বুঝতে পারি না যে। বড় শূন্যতা আসে বুকের ভেতর্। হু হু করে কান্না আসে। কিচ্ছু ভালো লাগে না যে। কেন এমন হয় বলতো বুড়ো ? "
     "শূন্যতা কি একা আসে গো? ..মনের কিছু না কিছু পাত্র সে ও পূর্ণ করে যায় গো। আমরাই তা বুঝতে পারি না। "
  "কি জানি ছাই কি সব কঠিন কঠিন কথা বলো তুমি। আমি মুখ্যু সুখ্যু মানুষ ,অত বুঝি না বাপু। "

                      *    *    *     *

     "কি হলো? দাঁড়িয়ে পড়ছো কেন বার বার? তাড়াতাড়ি এগোও!!!"
  "এই তো যাচ্ছি। "
         শিপ্রা স্বামীর সাথে সাথে পা চালায়। এসেছিল কালীপুজোর নেমন্তন্নে বরের অফিসের কোন হোমরা চোমরার বাড়িতে। এসব অপরিচিতের বাড়িতে আসতে একটুও ভালো লাগে না শিপ্রার। রায়গিন্নী ,চ্যাটার্জী গিন্নীদের রসালো আশঁটে গপ্পের সাথে নিজেকে কিছুতেই যেন মেশাতে পারে না।একটু আলাদা আলাদা হয়েই বসে থাকে সে। তবুও বসের বাড়ির পূজো বলে কথা। না আসারও সাহস পায়না মনতোষ.,কিছুতেই যেন বুঝতে চায় না শিপ্রার অনুভূতি. ........ মনতোষ ,তার দু বছরের বিবাহিত স্বামী। হিসেব করে ,পাঁজী দেখে ,নিয়ম মেনে বিয়ে হয়েছে তাদের ,দুই বাড়ির সন্মতিতে। সবকিছু ঠিকঠাক আছে ,তবু কেন জানি শিপ্রার মনে হয় ,বেহালা টা যেন ঠিক সুরে বাজছে না।সংসারের কমবেশি সব দায়িত্ব পালন করে মনতোষ । নিয়মমাফিক বিছানায়ও কাছে আসে বটে  ,তবুও প্রেমিক সে হয়ে ওঠেনি শিপ্রার। শুধু স্বামীই থেকে গেছে।

                    *     *      *      *

         "কিগো শিপ্রা? কি ভাবছো শুনি? ..পাশে বর ,এমন দীপাবলীর হেমন্তের রাত ,এমন সময় পরপুরুষের কথা ভাবতে নেই ,বুঝেছ?"
   "কে বলল যে আমি পরপুরুষের কথা ভাবছি? "
  "ও আমি বুঝি। আমি যে হেমন্ত গো। রহস্য দিয়েই যে আমার মাধুর্য্য। "
   "আমার বয়েই গেছে কারোর কথা ভাবতে। "
  "ঠিক বলছো তো? শুভদার কথা আর ভাবো না তো?
  "উফফ .,বিরক্ত করে মারলে। তুমি যাও দেখি! !!!"

                           *  *   *   *

   শুভদা ....উফফফফ.....এখনো যে কেন ছাই নামটা এত আগুন ধরায়!!!!! এত অপমান ,এত অবহেলার পরেও মোছে না। ভাবলেই গা হাত পা জ্বালা করে ,তবুও মনে আসবেই।
 
"তোর হাতের আঙ্গুল গুলো ঠিক চাঁপার কলির মতো ,জানিস? "
"ধ্যাত্ ,কি যে বলো! !"
  "হ্যাঁ রে .,সত্যি বলছি আমি...আমাদের টেলিফ্লিমে যে বিদেশী হিরোইন কাজ করছে ,ঠিক তার মতো দেখতে । "
  "শুভদা বলছে !!!!..এরপর ও শিপ্রা বিশ্বাস না করে পারে ?".,নিশ্চয়ই তাকে বিদেশী হিরোইন দের মতোই দেখতে হবেই হবে।

       শুভদার দৃঢ় হাতের মধ্যে পাখির পালকের মতো তিরতির করে কাঁপতো শিপ্রার হাত। সে মোহময় পুরুষ জাদুকরের মতো ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করতো তার সত্তা। ভালোলাগায় মরে যেত শিপ্রা। আর সেই জাদুকরের হাত খেলা করতো যুবতী শরীরের আনাচকানাচে ....

                   *    *     *     *

     "এই দাদা ,শিপ্রাকে একটু বাড়ি দিয়ে আয় দেখি। এই কালীপুজোর রাত ,বেচারি একা একা এতটা পথ যাবে ,"
  "না না আমি একা যেতে পারবো। কাউকে লাগবে না। " .,বিব্রত শিপ্রা বাধা দেয় ,আর মনেপ্রাণে চায় শুভদা চলুক।
         বাড়ি ফেরার এই একাকী কয়েকটা মুহূর্তের জন্য রক্তে আগুন ছোটে। শুভদা আর সে পাশাপাশি। অমাবস্যার রাত ,কিন্তু চারদিকে দীপালোকে আলোকিত। সবার বাড়ি সাজানো বাতি দিয়ে। .,.বিশ বছরের সেই যুবতী হৃদয় সর্বস্ব জলাঞ্জলি দিয়ে বসে আছে ওই এক হতচ্ছাড়ার জন্য।  গলিপথের সামান্য অন্ধকার স্থানে তাকে তীব্র বাঁধনে বাঁধে শুভদার দুটি সবল পুরুষালি হাত। নিমেষে ঠোঁটে সর্পদংশন। সারা শরীরে একের পর এক দংশন। মাথায় এক তীব্র ঝিমঝিম অনুভূতি নিয়ে শিপ্রা আবাহন করে তার ভবিতব্যকে।

   "দাদা ,শিপ্রা এসেছে রে। কি বলবে বলছে তোকে। জানিস দাদা ,শিপ্রার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে এই ফাল্গুনের ২২শে। "
  "তাই নাকি! !!!.দারুণ খবর! !!!!!!!!. ..কঅঅই শিপ্রা কঅঅই? "....."আরে ,শিপ্রা তোমার বিয়েতে তো গুছিয়ে আনন্দ করব সবাই...মেশোমশাই কে বলব অন্তত দশ হাজার টাকার বাজি কিনতে  হবে। দারুণ ফুর্তি করব সবাই মিলে। "
"শুভদা ,আমার কিছু বলার ছিলো তোমায় .....মানে ...."
"হ্যাঁ বল ....কি বলবি বল?  .,"
" মানে ..,আমি ....মানে ...."
   "হ্যাঁ ,কি? "
"মানে ..,মানে ..."
" কি মানে মানে করছিস? .কি হয়েছে বলতো?
"শুভদা........." ছলছলে চোখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে শিপ্রা। "
"ধুর পাগলি ,ওগুলো কেউ মনে রাখে নাকি? ওগুলো তো মজা। তোকে ছোট থেকে বড় করে দিলাম। "
"মানে? .....আমি কি করে পারব শুভদা? .."..চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে অবাধ্য জল।
"উফফফফ , চোখ মোছ ...এবার যা দেখি। .,"
"শুভদা ......."
"উফফফ এবার যা দেখি। এখন আর জ্বালাস নে। শোন আমি তোর জন্য নই। বিয়েটা কর। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।  "
তবু সে দাঁড়িয়ে থাকে অসহায় ভক্তের মতো। যেমন করে লোকে দাঁড়িয়ে থাকে প্রার্থনাগৃহের সামনে।
  "ওরে এবার যা। আমার অনেক কাজ সামনে ,স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে। নেক্সট উইক থেকে শুটিং ...."


      নাহ সে চোখে আর সেই জাদু নেই। সেই জাদুকর কখন তার পোশাক পাল্টে নিয়েছে , শিপ্রা বুঝতেই পারেনি। একে সে কি করে বলবে ,যে সারারাত ধরে সে ছটফট করেছে ? কিভাবে বলবে যে শুধু ভোরবেলায় তাকে বলার জন্য ছুটে এসেছে যে ,যেভাবে হোক এ বিয়ে তুমি বন্ধ করো ,নইলে সে বাঁচবে না?....এসব কথা আর বলা যায় নাকি একে?...সে যে ভারি লজ্জার ....যার কাছে সব দিয়ে বসে থাকলো সে যে ফিরেও তাকালো না। হা ঈশ্বর! !!!এরপরও এই ভাঙ্গা টুকরো গুলো গুছিয়ে গাছিয়ে তুলতে হবে?... সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে হবে অন্য কারোর জন্য?
   
                      *   *   *    *

    "দেখেছ তো ,আমি জানতাম ,তুমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুধু সেই হতচ্ছাড়াটার কথাই ভাববে।"
   "মোটেই আমি তার কথা ভাবছি না হেমন্ত, আমার কি অন্য কিছু কাজ নেই? "
  "ঠিক বলছো?"
  "হ্যাঁ তো ,.তাছাড়া মনতোষ খুব ভালো জানো? আমায় খুব ভালোবাসে। "
  "এই তো লক্ষী মেয়ের মতো কথা। এবার ভালো করে মনতোষের হাতটা জড়িয়ে ধরো দেখি,ঠিক সেদিনের মতো "
"কোনদিনের মতো? "
"সেইযে যে গো ,যেদিন শুভ তোমার পাশে ছিলো ,সেই দীপাবলীর রাতে? ,সেদিন ও যে আমিই তোমাদের কাছে এনেছিলুম গো। আমিই তো ধরিয়ে দিয়েছিলুম রক্তে আগুন। "
"তুমিই  করেছিলে? ??"
"তা না তো কি? ..আমার কাজই যে আগুন ধরানো। আমার কাজই যে ফসলের অপেক্ষায় বীজ বপন করা ....তার জন্যই না এত সমারোহ .,এতো আয়োজন ..."
  "কেন এমন করেছিলে হেমন্ত , সে যে বড়ো লজ্জার ঘটনা আমার জীবনে ..."
  "শুধু লজ্জাটাই দেখলে শিপ্রা? আর প্রাপ্তি টা? সেটা চিনলে না?,পাতা উল্টে দ্যাখো ,সেই রাত ,সেই তীব্র আশ্লেষ আমি ঠিক একইভাবে রেখে দিয়েছি,বিশ্বচরাচরে।  তাতে কোনো পাপ নেই ,কোনো মালিন্য নেই। সে যে আমারই রহস্য গো। সে ক্ষন হীরেকুচি হয়ে থাকুক নাহয় তোমার সিন্দুকে। তাকে মনেতে রেখেই নাহয় তুমি পথ চলো শিপ্রা। যুগে যুগে আমি যে নুতনের জন্যই বসে থাকি গো। নতুন ফসল ,নতুন জীবন ...চিরপুরাতন সাজে। "

                      *    *     *      *

  " আরে কি করো শিপ্রা ,এই রাস্তার মধ্যে এভাবে হাত ধরে হাঁটলে লোকে কি বলবে? "
  "বলুক গে,আমার ভারি বয়েই গেছে.,আমি আমার বরের হাত ধরে হাঁটছি মশাই ,তাতে কার কি?" 
হাহা করে অনাবিল আনন্দে হেসে ওঠে মনতোষ। স্ত্রী কে আলগা আলিঙ্গনে ধরে বেড় দিয়ে।

     দূরে পাতাঝরা গাছের আড়ালে হেমন্ত বুড়ো তার ফোকলা দাঁতে মুচকি হাসে।।
     



পাথর প্রতিমা
 ———————
 রবীন বসু

মুখে কালো কাপড়-ঢাকা যে মাওবাদী দলনেত্রী ব্যাংকে প্রবালের চেম্বারে ঢুকে তার মাথায় বন্দুক ঢেকিয়ে উঠে দাঁড়াতে নির্দেশ দিয়েছিল, তার গলাটা কেমন চেনা চেনা মনে  হচ্ছিল l
সময়ের  ঢেউ ভেঙে  ভেঙে একটা স্মৃতি  যখন এগিয়ে আসছিল,  ঠিক সেই সময় তার মাথার পিছনে ভারী কিছু দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল l  জ্ঞান হারিয়ে ছিল প্রবাল l তারপর আর কিচ্ছু মনে নেই l

এখন কত সময় কে জানে l আচ্ছন্ন ভাব কেটে আস্তে আস্তে জ্ঞান ফিরছে প্রবালের l ঘাড়ে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করল l অনেক কষ্টে চোখ মেলল l আবছা কয়েকটা মুখ তার উপর ঝুঁকে আছে l  উঠে বসার চেষ্টা করতে এজন মহিলা মাওবাদী এসে তাকে সাহায্য করে l তারপর তার সামনে একটা  জলের বোতল  রাখা  হল আর একটা বিস্কুটের প্যাকেট l প্রবাল শুধু একটু জল খেয়ে জিপের বাইরে জঙ্গলে চোখ রাখল l দুপাশে বড় বড় শাল গাছ l  মাঝে  মাঝে  তারাখচিত  একটুকরো  আকাশ l প্রবালের ভাবনার আকাশেও একটা তারা আনাগোনা করছে l সেই রহস্যময়ী গলা ! ব্যাঙ্ক যে লুঠ হয়েছে সেটা তো নিশ্চিত, কিন্তু তাকে অপহরণ করা হল কেন?

প্রায় শেষরাতে জঙ্গলের মধ্যে একটা সরু নদীর ধারের আস্তানায় তাকে আনা হল l  কালো পলিথিন সিট  দিয়ে তৈরি  অনেকগুলো  তাঁবু  l  মাঝখানে  অনেকটা খোলা জায়গা l বোধহয় ওখানে টার্গেট প্র্যাকটিস হয় l একটা  তাঁবুতে তাকে রাখা হল, বাইরে দুটি ছেলে AK47 নিয়ে পাহারায় l
প্রভাত সূর্যের আলো তাঁবুর মধ্যে তেরচা ভাবে পড়েছে l ব্যথায় আর ক্লান্তিতে প্রবালের চোখ জুড়ে আসছিল,খস খস শব্দে ওর চটক ভাঙে l চোখ তুলে দেখে মহিলা স্কোয়াডের দুজন সদস্যা তার সামনে l হাতের মগে গরম চা আর পাঁউরুটি l
— আচ্ছা, আপনারা তো ব্যাঙ্ক লুঠ করেছেন, মিশন
সাকসেসফুল—তাহলে আমাকে শুধু শুধু অপহরণ করলেন কেন?
—একটু ধৈর্য ধরুন, চা আর টিফিনটা খান l আমাদের এরিয়া কমান্ডার দিদি আর দাদা একটু পরে আসবেন, সব জানতে পারবেন l
—তা কেমন আছেন মিঃ ব্যানার্জী?
চমকে ওঠে প্রবাল l পুরো সৈনিকের মত ইউনিফর্ম পরে বকুল তার সামনে দাঁড়িয়ে l মাথায় কালো ফেট্টি বাঁধা l পিছনে বিকাশ, কলেজে তাদেরই সহপাঠী ছিল l ছাত্র রাজনীতি করত l
খবরের কাগজে পড়েছিল বিকাশ বলে একজন জঙ্গল মুণ্ডা নাম নিয়ে  এই  ঝাড়গ্রাম,  খয়রাশোল,  লালগড়, দুবরাজপুরের বিস্তৃত অঞ্চলে মাওবাদী সংগঠন গড়ে তুলছে l সেই বিকাশ যে তার সহপাঠী সে ভাবতেই পারে নি l
এবার বিকাশ সামনে এগিয়ে এল l—আমি তোর সেই কলেজবন্ধু বিকাশ l  পুরো প্ল্যানটা আমার l  একজন  শিক্ষিত ডাকাবুকো মেয়ে দরকার ছিল আমাদের l যাকে ট্রেনিং দিয়ে এরিয়া কমাণ্ডার বানাব l আর সে গ্রামে গিয়ে মেয়েদের বুঝিয়ে আমাদের সাথী-সমর্থক বাড়াবে l আমার প্রথম টার্গেট ছিল বকুল l তুই যে বকুলকে বিয়ে করেছিস, হনিমুন সেরে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসে ফিরছিস, কোন্ কোচে—সব খবর আমার কাছে ছিল l  তাই জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস ট্রেনে অ্যাকসিডেন্ট ঘটানো l আহত বকুল, তার সঙ্গে আরও কয়েকজনকে আমরা সেদিন তুলে নিয়ে গিয়েছিলাম l আজ বকুল আমাদের মহিলা স্কোয়াডের হেড lএকটু থেমে বিকাশ আবার বলতে শুরু করে, সংগঠন চালাতে টাকার প্রয়োজন, তাই ব্যাঙ্ক লুঠ l আর বকুল তোর সাথে একবার দেখা করতে চেয়েছিল সেটাও হল l তোকে অপহরণ করলাম এইজন্য যে, তুই এরপর মানসিক অসুস্থতার কথা বলে ট্রান্সফার চাইতে পারবি l তুই ঝাড়গ্রাম অঞ্চল থেকে সরে গেলে আমরা একটা বড় অপারেশনে নামব l অনেক কমরেড জেলে বন্দি, তাদের মুক্ত করতে স্থানীয় কিছু অফিসারকে পণবন্দী
করব আমরা l বকুল চায় না তোর কোন ক্ষতি হোক, তাই তোকে সরাবার এই রাস্তা আমরা বেছে নিয়েছি l
বিকাশ সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেল l তাঁবুর মধ্যে শুধু  বকুল l

আজ প্রায় দেড় বছর পর প্রবাল বকুলকে দেখছে l বকুলের চেহারাটা কেমন পালটে গেছে l আগের থেকে অনেক কালো আর রুখা হয়ে গেছে l চোখের দৃষ্টি খর l
—তুমি বাড়ি ফিরবে না বকুল?
—তা আর হবে না হয়তো l শয়তান বিকাশ ছাড়বে না l ওর প্রস্তাব ফিরিয়ে তোমাকে বিয়ে করেছিলাম, সেই রাগে আমার জীবনটা ছারখার করে দিল l
—তুমি যদি পালিয়ে আত্মসমর্পণ কর, তাহলে আমাদের সরকার তোমাকে পুনর্বাসন দেবে l
—আগে এই শয়তান বিকাশটার ব্যবস্থা করি l তারপর আত্মসমর্পণ l

সূর্য তখন পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে l গোধুলির লাল আলো সরু নদীর জলটাকে রাঙিয়ে দিয়েছে l সেই  রাঙা জলে হাঁটু ডুবিয়ে প্রবালকে নিয়ে দুই মাওবাদী জঙ্গলের পথ ধরল l ওকে ঘুরপথে জঙ্গল পার করে লোকালয়ের কাছাকাছি ছেড়ে আসবে l প্রবাল ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল নদীর পাড়ে পাথরের মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বকুল l


ত্রৈরাশিক

পায়েল খাঁড়া 
 



ব্যালকনির রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো তিস্তা।থেকে থেকেই দমকা হাওয়া এসে গায়ে  লাগছে । সাথে গুঁড়ো বৃষ্টির ছাঁট।শরৎ আকাশের এমন ভারী মুখ বড়ই স্বভাব বিরূদ্ধ।তিস্তার মনের ভিতরটাতেও ঝোড়ো তোলপাড়।এতদিন সে তো একাই সব ঝড়ঝাপটা সামলে এসেছে। সব প্রতিকূলতার বিরূদ্ধে একাই লড়েছে। কিন্তু আজ—আজ যেন সব’টা ঘাঁটাঘাঁটি হয়ে গেল।
দশ বছর আগে সৈকত এসেছিল ওর জীবনে।প্রথম প্রেম আর বন্যায় আগল ভাঙার মত ভেসে গেছিল তিস্তা।অথচ অনাগত সন্তানের দায়ভার নিতে রাজী ছিলনা সৈকত।তিস্তা ভালোবেসে ঠকে গেছিল। কিন্তু নিজের শরীরের ভেতর তিলে তিলে বেড়ে ওঠা একটা নিষ্পাপ জীবনের সাথে অবিচার করতে পারেনি সে।
বাড়ির অমতেই মা হয় তিস্তা।আইনত স্বীকৃতি পেলেও সমাজ মেনে নেয়নি তার এই বলিষ্ঠ মাতৃত্ব।তবু সব নিন্দে অপবাদ লোকলজ্জার হেমলক গিলে সে একাই মানুষ করে আসছে আরুষি’কে।সুচারুভাবে পালন করেছে প্রতিটা দায়িত্ব।মায়ের স্নেহ এবং পৈতৃক নিরাপত্তা কোনোটারই অভাব হতে দেয়নি সে।তবে, মাথার উপর বাবার প্রশ্রয় না থাকার দরুন’ই হোক আর দৈবক্রমেই হোক ,আরুষিও যেন ওর সমবয়সীদের তুলনায়  একটু বেশিই পরিনত। এইটুকু বয়সেও ও তিস্তাকে পুরোদস্তুর বোঝে,বোঝে তার একানে জীবন যুদ্ধটাকে। মা-মেয়ের এমন বোঝাপড়া সম্পর্কের অভিধানে হয়ত বা বিরল।

গেটের সামনে গাড়িটা এসে থামল।অভীক আরুষিকে পুজোর শপিং করিয়ে এনেছে। আরুষির দায়িত্বের অনেকটাই ইদানীং কতকটা জোর করেই সে নিয়ে নিয়েছে তিস্তার থেকে।নাহ,একজন অসহায় সিঙ্গেল মাদারের প্রতি নিছক করুণা নয় এ এক আলাদা অভিব্যক্তি।পাশের ফ্ল্যাটের মল্লিকাদি তো সেদিন অযাচিতভাবেই উপদেশের মোড়কে মন্তব্য হাঁকিয়ে গেল, “ঐ সব সফিস্টিকেটেড ব্যাচেলররা খুব একটা সুবিধের হয়না বুঝলে! দেখ, হয়ত কোনো অ্যাডভান্টেজ নেবে বলেই—”

কথাগুলো মানতে পারেনি তিস্তা।ওদের অফিসে তো সুন্দরী মেয়ের অভাব নেই! অভীকের প্রতি আকৃষ্টও অনেকেই।তবু সবাইকে ছেড়ে কেন ওর মত একটা মেয়ের জন্য—
তিস্তাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল অভীক,আরুষিকে অ্যাডপ্ট করে বৈধ স্বীকৃতিও দিতে চেয়েছিল । তিস্তাই বরং রাজি হয়নি।আসলে বিশ্বাসটা যে কাঁচের আয়নার মতই ঠুনকো, একবার ভাঙলে সহজে জোড়া লাগে না।তবু প্রত্যাখ্যাত হয়েও তো সে একই ভাবে জড়িয়ে আছে ওদের জীবনের সঙ্গে।এসব কি তবে শুধুই সুযোগ-স্বার্থে?এমন হাজারো প্রশ্ন মনের ভিতর হিজিবিজি কেটে যাচ্ছে, বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোটানা জেরবার করে রেখেছে তিস্তার  অন্তঃকরণকে। 
এত অল্প সময়ে আরুষিও কত গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে অভীকের সাথে।একটা কথা মনে পড়তেই ধক করে উঠল তিস্তার বুক, “ মামমাম,অভীক আঙ্কেল আমার  পাপা হতে পারে না?”প্রশ্নের প্রচ্ছদে এই প্রথম সে নিজে থেকে তার সুপ্ত কোনো বাসনা প্রকাশ করেছিল তিস্তার কাছে।
নীচে নেমে দরজা খুলে দাঁড়ালো তিস্তা।শপিংএর প্যাকেটগুলো তার হাতে দিয়ে অভীক বলল, “আর ঢুকব না রে,একটু তাড়া আছে।আচ্ছা আরুমা, আজ তাহলে আমি আসি!” দুই পা উঁচু করে তার গালে একটা চুমু দিয়ে আরুষি বলল, “কাল আবার এসো কিন্তু!” মাথা নেড়ে এগিয়ে যাচ্ছিল অভীক; তিস্তা পিছু ডাকল, 
-অভীক, কাল আসবি তো?
তিস্তার স্বরে আজ একদম অন্য উত্তাপ।অবাক হয়ে তার চোখের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকল অভীক ।তারপর আলতো হেসে বলল, “আসব”
জীবনের সব অঙ্ক গণিতের নিয়ম মানে না।তিস্তা তাকিয়ে দেখল মেঘ সরে গিয়ে শরতের আকাশটাও আবার ঝলমলিয়ে উঠেছে।




কবিতা



শুরুকথা
সুশান্ত ভট্টাচার্য


লবণের দানার মতো পৃথিবী
ইচ্ছে করলেই মুঠোয় পুরে ফেলতে পারি
মুসুরির ডালের মতো ঐ যে সূর্য
টিপ এঁকে দিতে পারি তোমার কপালে।

ভালবাসা একা থাকে ঐটুকু রুমালে

এই যে আমার হামাগুড়ি-আমগাছ বেয়ে
তরতর করে উঠে যাচ্ছে বিড়াল
এই যে আমার কাচের বাটিতে
নৌকা সুদ্ধ উঠে আসছে নদী

ব্রহ্মকমল,ভেসে যাওয়া রজ হৃদি।

এই যে আমার লতার মতো সরু সরু সেতুগুলি
এই যে আমার দেয়াশলাই খোপে ঘর ও গৃহস্থলী
এই যে আমার রুগ্ন পাতায় আধভেজা সত্তর
বেলুনের মতো রোবট নামছে পোড়া পোড়া অক্ষর।

এই যে আমার গোকুল ধারণা চুরি হয়ে যাওয়া ননি
এই যে শূন্যে ডিগবাজি খায় নীল নীল হাতছানি
এই যে আমার ছিন্ন জখম অণু পরমাণু যতো

ফিরিয়ে দিলে তবে কি তুমি গ্রহণেও অসম্মত।



চলে যাওয়া
 আর্যতীর্থ

কবি চলে গেলেন, তোমরা এমন করে কেন বলো ?
দেহ ছেড়ে চলে গেলে কবিরও মৃত্যু হয় নাকি?
কলম থামলো তাই মনের আবহাওয়া টলোমলো
তছনছ করে গেছে সুচারু জীবনে বিষাদের কালবৈশাখী।
তাই বলে কবিকে কাড়বে , সময়ের নেই সে ক্ষমতা,
শব্দরা রয়ে গেছে তাঁর, অনুগত পাঠকের মনে,
কবিতারা মন্থনে ওঠে, সাথে নিয়ে আসে অমরতা,
হাতখালি ফিরে যেতে হবে, সেই কথা মৃত্যুও জানে।
কলমটা থেমে গেলো জানি, সেই শোক উথালপাথাল,
নতুন সৃষ্টি এসে হড়কা বানের মতো আর ভাসাবে না,
দপ করে জ্বলবেনা নতুন লাইন পড়ে ভাবনা মশাল,
নতুন কবিতা কোনো হাত ধরে আনবাড়ি নিয়ে যাবে না।
এ ঘটনা ঘটেছে, ঘটছে ও ঘটবেই সময়ের সাথে,
নোঙর নামিয়ে দিয়ে জাহাজের থেকে নেমে যাবেন ক্যাপ্টেন
কবিতার পসরাকে সযত্নে লিখে দিয়ে আগামীর খাতে,
না ফেরা সফরের একমুখী নৌকায় চুপিচুপি তিনি চাপবেন।
অমোঘ মৃত্যুর দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়বে সেই কবিতারা,
পারো যদি তাদেরকে আমাদের মন থেকে কেড়ো হে শমন,
অতই সহজ নাকি দেহটি ছিনিয়ে নিয়ে সৃষ্টিকে মারা,
কবরে যায় না দেওয়া তাকে মাটি চাপা, চিতার আগুনে তার হয়না দহন।


  

প্রসঙ্গ_ম্যারিনেশন

কাজরী বসু

সুদীর্ঘ  ম্যারিনেশন..
জন্মগত স্বাদগন্ধের বিলুপ্তিসাধনের মূলমন্ত্র, 
যেমন, ঘোষিত মিসেস অমুক মিসেস তমুকের জেল্লায়,
আদা রসুন পেঁয়াজ বাটা,
টকদই,ধনে পাতা পেস্টের পুরু আস্তরণের আদলে...
অথবা  ইচ্ছেমতো সসের ব্যবহারের কায়দায়...
পরিণাম হিসেবে শেফের মর্জিমতো স্বাদের রকমফের..

তারপর মুর্গি হোক বা খাসি
উপকরণের অভিন্নতায় যা প্রায়শই স্বাদে গন্ধে এক।

কাঙ্ক্ষিত  ফারাকটুকু অবলুপ্তির দায়ভার কার..
এই অমোঘ প্রশ্নের সামনে নিরবধিকাল দাঁড়িয়ে থাকা তুমি
আর তোমার ম্যারিনেশন
এই সব কিছুকে অবজ্ঞা করতে শিখছি
এক প্রত্যাশিত স্বকীয়তার নিজস্ব সীলমোহরের লোভে..
জন্মকালীন পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা মৃত্তিকাগন্ধের খোঁজে...

যা মৌলিক আর তরতাজা
স্বাদে গন্ধে স্বতন্ত্র

আর ভাবছি
অভিন্নতার  কাছে আর কবে নতজানু হবে...
আর কবে...

মন কেমনের কাব্য
জাতবেদা মিশ্র

আজ অব্দি একটাও কবিতা লিখতে পারিনি জেনেও
সাজিয়ে চলেছি কবিতার মতো পঙতি
ছন্দ, মাত্রা, মনকেমনের গোলকধাঁধা
তারপর, রাতভর খুঁজে চলা নিজেকে
একটি একটি শব্দ তুলে নি,
আদর করি, হাত বুলাই স্নেহে
তবু তারা বেপথু হয়ে এদিক ওদিক।
ছড়ানো ছেটানো একেকটা দীর্ঘশ্বাস, যন্ত্রনা, বেদনা
খুঁদকুড়োর মতো খুঁটে খুঁটে রাখি হাতের চেটোয়।
বারবার দেখি, ভুল ছিল কতটুকু!
কতটা সন্তর্পনে চললে পায়ে আর ফুটবে না কাঁটা
যে রাখালিয়া মায়ায় ঘর ছাড়া হয় কবিতারা
তারা ভুলে যায় কী ভীষণ দ্রুত
সে মায়ার অনুভব মুছতেই জীবন পার
শুচিবায়ুগ্রস্তের মতো বারবার ধুয়ে যাই হাত
বিগত যৌবনের শেষ হাসিটুকুর মতো তবু তারা
রয়ে যায়,ছায়া হয়ে।
আবার গুছিয়ে ফেলি মন
জানি ভুল হবে আগামীতে ঠিক,
আজকাল আশাবাদী হতেও বড় ক্লান্ত লাগে।

খই ফোটা দিন
রথীন মণ্ডল

খইগুলো আশ্চর্য ছুঁয়ে থাকে
ধূলোময় ভাঙে আলো গান ভাষা

থেকে থেকে লাফ দেয়, নিরুদ্দেশে আঁকে
পরিধি ছাপানো এক পরিচয়, অচেনা হাওয়ায়

ক্রমাগত খুলে যায়, ভাসান মন্ত্র শুনে স্তব হয়
শাশ্বত জেগে থাকে খইফোটা দিন,নতমুখ ছায়া।


 
বেহুলা
বিশ্বজিৎ মাইতি

চলো গিয়ে গাঙুড়ের জলে পা ডুবিয়ে বসি,
এখুনি আকাশ এসে লাগিয়ে দেবে নীলছোপ
আমদের ক্লান্ত দু’পায়-
হিজলের ঝুরি এখনও ভোরের মতোই লাল,
দোয়েলের গান হেঁতাল বন
সবই আছে সেই আগেকার মতো,
ঠিক যেমন ছিল চাঁদ সদাগরের কালে।
দেখো ওই দূরে-
বুড়ো অশ্বত্থ গাছের পাশে হালি মনসা গাছের ঝোপ,
তারপরে উজানিনগর-
হয়তো লখিন্দরকে নিয়ে বেহুলা বেরিয়ে পড়েছে এতক্ষণ,
একটা সাজানো গল্পের খোঁজে-
জানি, বেহুলার জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছে খুব,

তবু যে তাকে নাচতেই হবে ছিন্ন খঞ্জনার মতো ভরা ইন্দ্রসভায়-

ডাক
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

একটা তীব্র ইচ্ছে যখন
নেমে আসে শরীর বেয়ে
তোমাকে পাওয়ার ,
এই বুকে টেনে এনে
জড়িয়ে ধরার সুখ
সেই তো অনুভব,
বিশ্বাসের সোপান বয়ে
তুমি কি আসবে অতৃপ্ত এই বুকে?
আসবে?
আমি এখনও রাতভর
তোমার  অপেক্ষায়।

  
আমার পৃথিবী
প্রত্যূষ কান্তি কর্মকার

বারান্দার এক কোণে এখন লিচুর দানার মত কালো অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে 
ওখানে তখন একটা কাঠের টেবিল ছিল 
টেবিলের ওপর ছিল পুরনো স্টোভ আর মা'র চোখের জলের দাগ 
মা'র পৃথিবীটা একটা ঘরের মধ্যে বন্দী ছিলো 
বন্দী ঘরে মায়ের পৃথিবী ছিলাম আমরা ভাই বোন 
আমাদের বলার কিছু ছিলো না, 
আমাদের ভয় আর বিস্ময় ছিল গরুর চোখের মত স্থির 
সরু রাস্তার শেষে উপচানো ডাস্টবিনের মত দুজনে একা একা ভাবতাম-শেষ, 
কি ভাবে জলের দাগে ছবি আঁকা যায়? 
কি করে সূর্যাস্তের আগে প্রশ্নটা পেড়ে ফেলা যায়! 
বাটি আর চামচের নাড়াচাড়া বাঙ্ময় হয়ে দেওয়ালে দেওয়ালে ঘুরপাক খেত, 
এভাবে ধ্বনি হয়ে মেঘের আড়ালে ছুঁয়ে যেত গল্প বলা জানালার রোদ 
স্টোভের শন শন আওয়াজে ন্যুব্জ মৃদু প্রতিবাদ বলে যেত তিন সত্যি 
কাঠের সিলিং ফুঁড়ে আকাশের আনাচ কানাচ ঘুরে, 
কেউ ডাকবে ভেবে মুখ গুঁজে অসহায়তার আদিম পাঠে তিরতিরে আত্মসমর্পণ,
প্রার্থনা সরু রাস্তার শেষে,
এখনও বন্যার জলের মত মনে পড়ে, 
চোখ শুকোতে চোখ মেলেছি পথে আর রোদ্দুরে।


 
ব্যক্তিগত স্বপ্নাবলী
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার

হাওয়ায় ভেসেছি আমি হাওয়ায় ভেসেছি প্রতিদিন
স্বপ্নের সাদা ঘোড়া সাদা ঢেউ কালো মাস্তুল
হাতের চাবুকখানা অবিকল এক শঙ্খচূড়
সপাসপ জিভ মেলে গিলে নিতো স্মিতমুখী প্রেম

উফ কি বিষাদময় সেইসব ফেননিভ দিন
আহ কি পরম প্রিয় অলীক গল্পবাজ মেঘ
বিরাট বাহুর মত ডানা মেলে দিত শ্বেত চিল
পেটভাসি ভেসে ভেসে জলপোয়ানোর দিনগুলো

মধ্যে বছর গেছে মাস গেছে এক এক ক্ষণ
ঘটনা গড়িয়ে গেছে পায়ে পায়ে সময়ের মতো
আমার শিকড়ে দেখো স্বপ্ন জড়িয়ে গেছে জালে
কই গো কোথায় বলে অথচ খুঁজছি আমি তাকে

এখন যে পাশাপাশি দুইজন শরীরে ঘুমাই
এখন যে পাশাপাশি দুইজন জাগি মনে মনে
সোনায় জড়িয়ে রাখি চুলচেরা সমস্ত বিষাদ
স্বপ্নের মত গাঢ় বেদনারা টলটল করে

সেইসব বেদনার পিঠে দিলে জাহাজের পাল
ছইছপ ভেসে যায় উদগ্রীব দক্ষিণমুখে
ফেনাগুলো মন দিয়ে টুকে টুকে রাখি আজকাল
ওরাও ব্যক্তিগত অনেকটা স্বপ্নের মতো।


Sunday 5 November 2017

সাহিত্য এখন, নভেম্বর প্রথম পক্ষ


সম্পাদকীয়

এখন কার্তিক মাস। হাওয়ায় হিমেল গন্ধ ভেসে আসছে। গ্রামবাংলার ভরন্ত বুকে  ধানগাছের সারি আমার আপনার ঘরের সন্তানের মতই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে কৈশোরের ঔৎসুক্যে আর কোমল দৃপ্ততায়। মানুষের মনে নতুন সাধ, নতুন আশা ভরসা। 'সাহিত্য এখন' পাক্ষিক অনলাইন পত্রিকা হিসাবে পা বাড়াবে, এমন একটা আশা সুপ্ত হয়ে ছিল অনেক দিন ধরেই। আজ তাই সে পথে পা বাড়ালাম। ভরসা রাখি আপনাদের পাশে পাব। আমাদের এই পত্রিকা নতুন ধানের মতই উজ্জ্বল আশ্বাস নিয়ে আসুক, এটুকুই প্রার্থনা।


দুটি অনু গল্প
গোপেশ দে

পরিবর্তন
বিরাটের ভেতরে বেশ কিছুদিন ধরে একটা আমূল পরিবর্তন লক্ষ্য করছে ওর বন্ধুরা।বাড়িতে সারাদিন একা একা বসে থাকে ও।দুচারটে গান শোনে তাও আবার রবীন্দ্রসঙ্গীত।অথচ এই সেদিনও হিন্দি ডিজে গানে গা ভাসিয়ে দিতো।এই পরিবর্তন বাড়ির লোককেও কিছুটা চমকে দিয়েছে।গৌরব প্রায়ই ওর বাড়িতে আসে।বিকেলে বেরুতে বলে।ক্লাবে ক্যারাম খেলার জন্য আসতে বলে,রাতে মদের জলসা।কোনো কিছুকেই পাত্তা দিচ্ছেনা ও।অথচ এই সেদিনও ও বন্ধুদের সাথে হৈ হুল্লোর,রকে বসে মেয়ে দেখলে শিটি, রাতে ভদকা,রামে মাতোয়ারা,উৎসর বাইকে করে অনেকদূরে চরুইভাতি করেছে।বন্ধুদের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।শুধু একটি কাজ ও খুব মন দিয়ে করছে।ওদের পাড়ার দীপ্তিকে ফেসবুকে সকালে গুড মর্নিং রাতে গুড নাইট এসব দিতে ভুলে না ও।ওর ভেতরে এতোটা পরিবর্তনের কারণ অবশ্য আছে।দীপ্তিকে ও যেদিন প্রপোজ করে মেয়েটা এক রাশ ঘৃণা এনে বলে,লজ্জা করেনা আমাকে প্রপোজ করতে।নিজে কতটা খারাপ একবার ভেবে দেখেছো?চায়ের দোকানে বসে মেয়ে দেখলে বাজে আচরণ,শিটি,রাতভর মদ গেলো।আবার আমার পেছনে এখন লেগেছো?এই কথাগুলোর পর ও দীপ্তিকে আর সামনা সামনি বিশেষ কিছু বলার সাহস পায়নি।সেদিন থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওসব ছেড়ে দেবে।দীপ্তিকে যে সত্যিকারের ভালোবাসে ও।শুধু ফেসবুকে রোজই একটা কথাই বলে,আমি ওসব খারাপ অভ্যেস ছেড়ে দিয়েছি।আমাকে আর ওসব করতে কখনই দেখবেনা তুমি।সারাদিন বাড়িতেই বসে থাকি।শুধু তোমার ভালোবাসার জন্যই আমি সব কিছু ছাড়তে রাজি আছি।একটিবার বলো ভালোবাসি।এসব ন্যাকা কথায় দীপ্তির মন কিছুতেই গলে না।সে বলে দিয়েছে,কুকুরের লেজ কখনই সোজা হয়না।এভাবেই দিন চলল।কিন্তু একদিন বিকেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছু দূর আসতেই দেখতে পেল দীপ্তি ঠিক ওর সামনে দিয়েই অয়নদার বাইকের পেছনে বসে কোথায় যেন যাচ্ছে।ওর সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো।অয়নদা!দীপ্তি কি অয়নদার ব্যাপারখানা জানেনা।আসলে বিরাট অয়নদাকে দুমাস আগে অন্য একটি মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে দেখেছে।একদিন না বেশ কিছুদিন।সেও মদ,সিগারেট সবই খায়।আর মেয়ে দেখলে জিভ লকলক করে।কিন্তু দীপ্তি এটা কী করল।রাতে দীপ্তিকে ফেসবুকে অয়নদার প্রসঙ্গটা বলতেই দীপ্তি লিখে দেয়,অয়ন আমার বয়ফ্রেন্ড।তুমি আর আমায় ডিস্টার্ব করবেনা।বিরাট ফেসবুক থেকে বেরিয়ে এসে নিজের মনেই বলে,এই তাহলে সমাজ!কিছুক্ষণ পর ও গৌরবকে ফোন করে বলে,ভদকার পাঁইট রেডি কর।আজ সারারাত আড্ডা হবে,ডিজে হবে।বলেই ফোনটা কেটে দিল আর বিড়বিড় করে বলল,কুকুরের লেজ সত্যিই সোজা হয়না!

এক্কাদোক্কা
সায়নীর ছোট্ট সংসার।একমাত্র ছেলে বয়স ১০ ক্লাস ফাইভে পড়ে।বর মাল্টিন্যাশনাল জব করে।ওদের বাড়িটি অনেক বনেদিআনা।চারপাশেই ঘর আর মাঝখানে একটা উঠোন সাথে তুলসীমঞ্চ।ওর জা ভাসুর সবাই একই বাড়িতে থাকে।ওর বর নীলাদ্রি চার ভাই।নীলাদ্রি সবার ছোটো।বাকি তিনজনের মেঝজন বিহারে একটা ব্যবসা করে।বাকি দুই দাদা এই বাড়িতেই থাকে।তবে সবাই আলাদাভাবে থাকে।একান্নবর্তী ব্যপারটা নেই।নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি।ভরদুপুরে প্রায় সময়ই একা একা বসে টিভি সিরিয়াল দেখে সায়নী।ছেলে স্কুলে,ছেলের বাবা অফিসে।আজ হঠাৎ দুপুরে লোডশেডিং হওয়ায় ঘরের পেছনের জানলাটা খুলে বসল ও।শীতের দিন।পেছনের জানলা দিয়ে হালকা রোদ এসে পড়ছে।বেশ ভালোই লাগছে।হঠাৎ চোখ গেল দূরের একটা বাড়ির ছাদে।একটা বাচ্চা মেয়ে ছাদের ওপর  কি যেন খেলছে।সায়নী একবার চোখ ফেলেই বুঝে নিল খেলাটা এক্কাদোক্কা।হঠাৎ ওর ভেতর সোনালী স্মৃতি চকচক করে উঠল যেন চোখের সামনে এইচডি পর্দা।সে ও তারসাথে আরো তিন চারটে মেয়ে রাস্তার পাশে দাগ টেনে খেলা শুরু করল।গ্রামের সহজ সাদামাটা রাস্তা।মাটির ওপর আয়তকার দাগ টেনে তারপর ঘরের ভেতরে আড়াআড়িভাবে সরল রেখা টেনে ছয়টি খোপ করে ভাঙা কলসীর চাড়া নিয়ে সেই ছোটোবেলার খেলা।অনেক দিন পর সায়নী নস্টালজিক হয়ে গেল।সত্যি কী আনন্দের দিনই না গেছে ওদের!এখন সবাই যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত।এক্কাদোক্কা খেলা কোনো গ্রামের বাড়ি কি রাস্তায় আর দেখা মেলেনা।সায়নী এখনও একনজরে বাচ্চা মেয়েটির খেলা দেখছে।

অনুগল্প 
অতনু টিকাইৎ


রাজনীতি 

'এতো তাড়াতাড়ি হারামির বাচ্চাগুলো মুখ ফিরিয়ে নেবে ভাবা যায়!' --- বলেই পার্টি অফিসে ঢোকে স্থানীয় যুব নেতা বিপ্লব দাস। স্থানীয় MLA এর ডাকে আজ আলোচনা সভা বসেছে পার্টি অফিসে। সামনেই বিধানসভা ভোট। কিভাবে এই ভোটে জয়লাভ করা যায় তাই এই আলোচনা সভার প্রধান বিষয়। আলোচনায় উপস্থিত MLA সহ স্থানীয় প্রথম সারির কয়েকজন দাপুটে নেতা।
বিপ্লব দাসের এমন উক্তির কারন বর্তমানে স্থানীয় মানুষদের আচার ব‍্যবহার যাতে স্পষ্ট হয় বেশিরভাগ মানুষজন তাদের পার্টি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন এই পাঁচ বছরের মধ‍্যেই অথচ একটা সময় এই মানুষরাই একত্রিত হয়ে তাদের পার্টিকে বিপুল ভোটে জিতিয়েছিল, পার্টির নেতাদের তাদের হৃদয়ে জায়গা দিয়েছিল।
মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারন অবশ‍্য  স্বয়ং MLA থেকে স্থানীয় নেতা কারুরই অজানা নয়।
যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাদের পার্টি ক্ষমতায় এসেছিল, যেমন স্থানীয় পাকা রাস্তা, পর্যাপ্ত পানীয় জল, বেকার সমস‍্যা দুরীকরন এর মতো অনেকগুলি স্থানীয় সমস‍্যা তার কোনটারই সুফল পায়নি জনগন।
রাস্তাটা যদিওবা করা হয়েছিল কিন্তু কয়েকমাস এর মধ‍্যেই তা নষ্ট হয়ে যায়, জলের সমস‍্যার কোন সমাধান হয়নি এবং স্থানীয় বেকার যুবকদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। রাগটা আরও চরমে উঠেছে যখন দেখেছে নেতা ঘনিষ্ট যোগ‍্যতা না থাকা ব‍্যক্তিদের চাকরি হয়েছে।
'কিচ্ছু চিন্তা করবেন না দাদা, আমরা আছি তো। কাজ আগের পার্টি'ই বা কি করেছিল তবু তো তারা এতোগুলো বছর ছিল ক্ষমতায়, নেতা মানে কি ভগবান নাকি যে মানুষ যা চাইবে তাই করে দিতে পারবো আমরা, আর এসব মানুষ বোঝে। কিচ্ছু চিন্তা করবেননা। আমরাই আছি, আমরাই থাকবো।' --- এই বলে MLA এর চিন্তা কমানোর চেষ্টা করেন স্থানীয় দাপুটে নেতা অরিন্দম চ‍্যাটার্জ্জী।
পাশের আরেক নেতা এই শুনে বলে ওঠে --- 'দুই পরিস্থিতি এক নয় অরিন্দমদা। ওই পার্টিতে কালু মস্তানরা ছিল, আমাদের পার্টিতে আছে এমন কেউ যারা ভোটের আগের রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের ধমক দিয়ে আসবে, ভোট লুটবে? আর ভোট না লুট করে মানুষের ভরসায় ভোট হলে আগের পার্টিও ওতোদিন থাকতোনা আর আমরাও থাকবোনা।
বিশ্বাস করুন বা না করুন বাসুদেবদাদা, এটাই fact।'
কালিপদ দাস ওরফে কালু মস্তান। আগের পার্টির শেষ অস্ত্র ছিল এই কালু। কিন্তু আগেরবার বিধানসভা ভোটে সাধারন মানুষ বর্তমান MLA বাসুদেববাবুর নেতৃত্বে একজোট হয়ে স্থানীয় নেতা ও কালুর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষনা করে। এরজন‍্য বাসুদেববাবুকে কম কাঠ্-খড় পোড়াতে হয়নি। দিনের পর দিন মানুষের মধ‍্যে থেকেছেন, অসুবিধায় পাশে দাঁড়িয়েছেন, মানুষকে বুঝিয়েছেন ঘুরে দাড়ালেই সুদিন নিশ্চিত, আস্থা দিয়েছেন যেমন পাশে রয়েছেন কিন্তু ক্ষমতা না থাকায় চেয়েও করতে পারছেননা অনেক কিছুই, ক্ষমতা পেলেই সেসব কাজ করে দেবেন চুটকি মেরে। মানুষও সেইসময়কার পার্টির নেতাদের এবং সাথে কালু মস্তানদের নানান দুষ্কৃতিমুলক কাজের থেকে রেহাই পেতে পথ খুঁজতে জড়িয়ে ধরেন বাসুদেববাবুকে। জয়লাভ করে বাসুদেববাবুর দল। জয়লাভের সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ব পার্টির বহু স্থানীয় নেতার সাথে কালু মস্তানও ঘরছাড়া। এই পাঁচ বছর কালু কোথায় আছে, কি করছে কেউ জানেনা। স্থানীয় মানুষজন তার ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল ভোটের রেজাল্ট বেরোনোর দিন'ই।
তারপর অনেক জল গড়িয়ে গেছে। এক বিধানসভা ভোটের পেরিয়ে আরেক বিধানসভা ভোট এসেছে। মানুষের বিশ্বাস গড়েছে ভেঙেছে। মুখোশ খুলেছে অনেকের। দুরত্ব বেড়েছে বাসুদেববাবুর সাথে মানুষের।
এতোদিন সব ঠিক থাকলেও ভোটের নির্ঘন্ট বাজার সাথে সাথেই কপালে ভাঁজ দীর্ঘ হয়েছে পার্টির স্থানীয় নেতা সহ স্বয়ং MLA এর।
ভাবুক প্রত‍্যেকেই, চিন্তিতও। অবশেষ আলোচনা সভার নীরবতা ভেঙ্গে বাসুদেববাবু জানতে চান --- 'কালু এখন কোথায় থাকে কেউ জানিস?'
'শুনেছিলাম ওর শ্বশুরবাড়ির গ্রামে ঘর বানিয়ে থাকছে।' --- উত্তর আসে।
---- 'ওকে বল গিয়ে বাসুদেবদা ডেকেছে। দরকার আছে।'


কবিতা 

প্রবেশ নিষেধ
দেবাশীষ সান্যাল

পদ্মা কিংবা গঙ্গা
ঢাকা থেকে কোলকাতা
কোথাও তোমার চাকরী নেই যুবক!

কাঁধে বন্দুক
পশ্চাতে ১৪ প্ল্যাটুন তীরন্দাজ
রাষ্ট্রনায়ক এখন দেশ শাসনে বিভোর।
ওখানে তোমার প্রবেশ নিষেধ!
যতই চাও না স্বীকৃতি
বেকারত্বের অভিশাপ
তোমার পিঠে শতাব্দীর দগদগে ঘা হে যুবক!
যতই তোমার চোখে জাগুক বিস্ময়।
জেনে রেখো
এই জনমে তোমাকেই বেঁধে রেখে দেবে
বিপুল কংকালসার দেহ!
তোমার চেতনার দৈন্যতায়
কখনোই জেগে উঠবে না
পথভ্রষ্ট মহাকাল!
হায় অমানিশা কৃষ্ণপক্ষ
তোমাকে আর কে শেখাবে বলো
কার্ল মার্ক্সের অ আ ক খ?




নিবিড়  থেকে থেকে নির্জনে
পিনাকী দত্তগুপ্ত

একা থাকার উপহার তুমি ফিরিয়ে নিয়েছো
অতঃপর। আমি প্রতিবাদ করিনি; কারণ,
তুমি জানতে, যত কাছে আসবো প্রতিদিন,
ততটাই একা হয়ে যাবো দুইজনে। নির্জনে ।

রাতের অন্ধকারে ছায়া মাখে হেমন্তের বক।
ঝাপসা কুয়াশা নামে অবসন্ন আমনের মাঠে।
অচেনা নারীর খোঁজে ঝরে পড়ে চেনা লুব্ধক;
দীর্ঘশ্বাস জমে শেষ প্রহরের খেয়া-ঘাটে।

তবুও যখন তুমি ফিরিয়ে নিয়েছো তানপুরা,
জানাইনি দাবি, জানি ওই সুর বাজবেনা আর।
কারণ আমি জানতাম, আমরা ঠিক ততটাই
দূরে সরে যাচ্ছি প্রতদিন, যতটা নিবিড় হয়েছি
“চেতনে কিংবা অচেতনে”।


ফিনিক্স পাখি
মতিউল ইসলাম

"ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচি-
ন্নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে" ||

ফিনিক্স পাখির ঠোঁটে এক টুকরো আগুন,
নতুন জীবনের জন্য মৃত্যু চাই,
পোড়া অস্থি আর বাসস্থানের মধ্যে থেকে
জন্ম নেবে নবজাতক.
চলো পবিত্র হওয়ার জন্য
আগুন জ্বালি,
পুড়ে যাক বাক্সবন্দী অহং,
দিগন্ত বিস্তৃত আমিত্ব,
চলো পুড়িয়ে ফেলি লালসার বীজ.
যমদূত আসার আগেই
আত্মায় আগুন দিই,
যমদূতের বিস্ফারিত চোখের সামনে-
নগণ্য মানুষ থেকে চলো
ফিনিক্স পাখি হয়ে যাই.

মিছিল
বিশ্বজিৎ মাইতি

পৃথিবীর ব্যাস বরাবর চলো আমরা মোমবাতি মিছিল করি-
জানি অন্ধকারে শুয়ে আছে আমাদের আত্মীয় স্বজন তবু
কুচকাওয়াজ থামাও প্রিয়তম
যুদ্ধ থেমে গেছে,
আমি দিয়ে এসেছি একশত গোলাপের চারা
যুদ্ধবাজের হাতে।
চলো এবার ভোরের রোদে ডুব দিয়ে আসি,
দিগন্তে মুখোমুখি বসব এসে আমরা
তারপর,
কে আছো কাঁটাতার গুটিয়ে নাও-
এখুনি মাটি ভেদ করে জন্ম নেবে উদ্ভিদ,
রঙচটা কফিনের পাশে।

 ক্যানভাস
সুশান্ত ভট্টাচার্য 

 উকুন এক প্রাণী বিশেষ

চুলের গভীরে
দ্রুত ফেলে শ্বাস

আমার ঝাঁকড়া চুল
আলতো চিরুণী চালাই

উকুন কি কবির বাহন
জল রঙে যাকে আঁকতিস।


যাবো ভেবে  
প্রত্যূষ কান্তি কর্মকার  

যাবো ভেবে যেতে পারিনি এখনও
যাওয়া মানে সমূহ অন্ধকার
স্তব্ধ হয়েছে সব তরবারি
বাঁচা মরা সনাতন ঘর বার
তরল হাওয়ায় ভেসেছে সব গান
আগুনের পরিপাটি সাধনার ভোর
বেঁচে থাকা ভেবে ছুঁয়ে গেছি যত মূল
তার সবটাই শুধু ঘন হয়ে থাকা ঘোর
রাত্রি নিবিড় হলে জোনাকিরা কথা বলে
আলোর বিন্দু প্রান্তরে যায় ভেসে
শরীর থেকে ঝরে পড়ে যায় বিপন্নতার পালক
আগুন শিখর ছাইয়ে ডোবে অবশেষে
মুঠোয় থাকা লাভার বিচ্ছুরণ
টেবিলের কোণে মাথা নুয়ে পড়ে আছে
ভুলে গেছি তার আপামর প্রবণতা,
কুহকের চোখ সংকেতে কাছে ডাকে


অক্ষর লিখি চল
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার

আঁকড়ে ধরেছি স্মৃতির দরজাখানা 
পুরনো সময় হাসছে সকৌতুক 
অবাক হচ্ছ? তোমারও কি আছে জানা 
কোন দিকে যাবে জীবনের অভিমুখ? 

ভাতের থালায় জ্যোৎস্না ফুটতে দেখি 
খালের শরীরে ভাসে রূপবতী মাছ 
কিভাবে লিখব এইসব ভালোলাগা 
কিভাবে লিখব এত স্নেহময়ী গাছ?

আরও কিছু আছে এসময়কার কথা 
সব কথা নয় বৃষ্টি রৌদ্র মেঘ 
আরও কিছু আছে লজ্জিত শব্দাদি 
বোবা চীৎকার ঝলসানো উদ্বেগ 

নতুন কবিতা পাশ ফিরে শুয়ে আছে 
পুরনো কবিতা গায়ে লিখে দেয় ঋণ 
যেসব দশক আঁকড়ে ধরেছি আমি 
খুন হয়ে গেছে তাদের সোনালি দিন 

অক্ষর লিখি বাঁধভাঙা বিন্যাসে 
অক্ষর লিখি আগুন এবং জল 
ফুরিয়ে যাচ্ছে যেসব শিশু ও পাখী 
আজ সেইসব অক্ষর লিখি চল।