Sunday 28 January 2018

সাহিত্য এখন,জানুয়ারি ২০১৮

সাহিত্য এখন,বইমেলা সংখ্যা


সম্পাদকীয় 
বইমেলা আসছে।সাজো সাজো রব চারদিকে।অসংখ্য নতুন বইয়ের খবর পাচ্ছি। তাদের মধ্যে কেউ কি বেস্ট সেলারের দলে নাম লেখাতে পারবে?পুরনো বেশ কিছু বই এখনও সেরাদের তালিকায় স্বমহিমায় বিরাজমান।  এবছরও কি বজায় থাকবে তাদের দাপট? এইসব হাজারো প্রশ্ন মনের কোণায় এসে ঘুরপাক খাচ্ছে।বইমেলা যতই স্থান বদল করুক, আমরা পুরোদস্তুর মেলাতেই আছি।

মেলার কথা ভাবলে এখনো ময়দানের সেই পুরনো ধুলো ধুলো গন্ধটা নাকের ডগায় এসে সুড়সুড়ি দেয়। সেই ভস্তকের দরজায় কেমন হুড়োহুড়ি করে  ভীড় জমাতাম সস্তায় গোগোল,তুর্গেনিভ,টলস্টয়কে পকেটে পুরব বলে... স্টলে দাঁড়িয়ে অর্ধেক বই শেষ করে ফেলতাম।নতুন বই পড়ার আনন্দে দিব্যি হজম করে ফেলতাম বোম্বাই গুঁতোগাঁতা। আচ্ছা,এখনো কি কম বয়েসীরা এভাবেই বই পড়ে? ছোটরা? খুব জানতে ইচ্ছে করে।কিন্তু আগের মত প্রতিদিন বইমেলা চষে ফেলার সময়টা কখন যেন বাড়ির কচিকাঁচাদের পরীক্ষার সিলেবাসের তলায় চিঁড়েচ্যাপটা হয়ে পড়ে আছে।সাধ থাকলেও তাকে উদ্ধার করার সাধ্য নেই।

তবু এরই মধ্যে যেটুকু খবর কানে আসছে, মানুষ আবার বইমুখো হচ্ছেন। অনেক বেশি মানুষ কলম ধরছেন,পড়ছেনও। আমার আপনার মত বইপোকাদের জন্যে এসব খবর সুসংবাদ বইকি।তবে ছোটদের জন্যে তেমন করে কলম ধরছেন কি কেউ? তাদের বোকাবাক্সের আর ভিডিও গেমের কবল থেকে উদ্ধার করার জন্য সুপারম্যানের মতই একজন সুপার অথরের অপেক্ষায় রইলাম।বইমেলা ভাল কাটুক।দেখা হবে।



মনের কথা(৫)
সৌরভ ভট্টাচার্য

‘দেশ’ পত্রিকার এবারের সংখ্যাটা হাতে পেলাম। রামকৃষ্ণদেবের অপূর্ব একটা ছবিতে মন আটকালো। লেখাগুলো মন দিয়ে পড়লাম। প্রথম লেখাটা নিয়ে কিছু বলার নেই, অর্থাৎ মার্টিন কেম্পশেনের লেখাটা, কথামৃতের অনুবাদ সংক্রান্ত।
     পরের লেখা দুটো ভাবালো। রামকৃষ্ণদেবের ছবি বাঙালী পরিবারে জন্মসূত্রে ছোটোবেলা থেকেই দেখে আসছি। মাঝখানে মা-কালীর দু’পাশে রামকৃষ্ণ, সারদাদেবী আর সামনে বিবেকানন্দ। বাবা প্রণাম করে অফিস বেরোতেন। মা স্নান করে প্রণাম করতেন। তারপর ঠাকুমার লেজুড় হয়ে থাকার সুবাদে বাংলা সিনেমায় রামকৃষ্ণের চরিত্রায়ণ দেখলাম। বুঝলাম ঈশ্বর এক, এই ওনার সব চাইতে বড় উপলব্ধি – যত মত তত পথ। তারপর স্কুলের কর্মশিক্ষা পরীক্ষায় প্লাস্টার অব প্যারিসে সবচাইতে পপুলার ছিলেন রামকৃষ্ণদেব। তাই লাগানো হল। শিক্ষক জিজ্ঞাসা করলেন, ইনি কেন বিখ্যাত ছিলেন? উত্তর দিলাম, যত মত তত পথ বলেছিলেন। কিন্তু সেইটা উপলব্ধি করে জগতে যে কি উপকার হল তা বুঝিনি। শিক্ষক বললেন, শুধু তাই নয়, তিনি মা কালীর দর্শন পেয়েছিলেন। সেই কথা শুনে যতটা না শ্রদ্ধা জন্মালো, তার চাইতে বেশি জন্মালো কৌতুহল।
    তারপর পড়াশোনা বাড়ল। ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি নানা বিষয়ে। অবশ্যই আউট অব সিলেবাসের পড়া সেগুলো, কারণ নিজে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। সেদিন পড়েছিলাম, রামকৃষ্ণদেব ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’ করেছিলেন; আজও ‘দেশ’-এ সেই কথাটার উপরেই সব চাইতে বড় জোর দেখলাম। সেদিনও বুঝিনি, আজও বুঝলাম না, তাতে কি লাভ হল? কথামৃত ভারতের নানা ভাষায় অনূদিত হল, প্রচুর রামকৃষ্ণ মিশনের শাখা-উপশাখা খোলা হল। কত বড় বড় নামধারী শিক্ষিত কৃতী সন্তানেরা সন্ন্যাসী হল, কত লেকচার হল, কত অধিবেশন হল, কত বই লেখা হল, কত সেই বইগুলোর উপর বই লেখা হল...
     তাতে কি হল?
     ভারতের আজকের অবস্থানটাই কি তার যথেষ্ট নিষ্ফলতার প্রমাণপত্র নয়? কতগুলো দাঙ্গা হয়ে গেল ধর্মের নামে। আজও কত জায়গায় গনগনে আগুনের তাপ - ফুঁসছে সব। সলতে পাকানোই আছে, শুধু ফুলকির অপেক্ষা। কোথায় ‘যত পথ তত মত’-এর নমুনা? সেকি শুধু পাণ্ডিত্যের আর লেকচারের বিষয়? তবে গোলমালটা কোথায় হল?
     অনেকেই দোষটা রাজনীতির ঘাড়ে চাপিয়ে দায় এড়াতে চাইবেন। কিন্তু অতটা সরলীকরণের জায়গায় দাঁড়িয়ে কি আমরা? নয় তো। গোড়ায় গলদটা তো রয়েই যাচ্ছে। সেটা কি?

     প্রথম কথা, ধর্মে কি কোনোদিন সমন্বয় সম্ভব? এর উত্তর ‘হ্যাঁ’ আর ‘না’ দুটোই। যা লালন পারেন, কবীর পারেন, সেই অর্থে রামকৃষ্ণ ব্যর্থ হন। তার কারণ, রামকৃষ্ণ যতই পৃথক ধর্মমত প্রবর্তন না করে থাকুন, কিন্তু তাঁকে নিয়ে একটা সম্প্রদায়, ‘মিশন’ তৈরি হয়েছে। একটা সম্প্রদায় ‘সব সম্প্রদায়’ সমান প্রচার করতে পারেন, কিন্তু সেটার জ্বলন্ত প্রমাণ হতে পারেন কি? হতে পারে সেখানে খ্রীষ্টানের মত পঁচিশে ডিসেম্বর, বৌদ্ধের মত বুদ্ধপূর্ণিমা, প্রাচীন হিন্দুর মত দূর্গাপূজা ইত্যাদির প্রচলন আছে; তাতে করে পাঁচমিশালি একটা সংস্কৃতি হয়, যার কোনোটাই আসল নয়, কিম্বা কোনটা আসল এই প্রশ্নে মানুষ বিভ্রান্ত হয়; কারণ সবক’টাই যে ‘মতো’, আসল তো নয়। যে খাঁটি খৃষ্টান সে চার্চে যাবে, যে খাঁটি মুসলিম সে মসজিদে যাবে, সে কেন বেলুড়ে যাবে? সময় কাটাতে, কৌতুহল মেটাতে, বা একজন দু’জন হয়ত বা আসতে পারেন, কিন্তু সামগ্রিকভাবে সেটা একটা ‘মতো’, আসল নয়।
     রামকৃষ্ণদেব কি তাই চাইতেন? তার নামে মন্দির হয়ে এরকম একটা পাঁচমেশালি কিছু হোক? সর্বোপরি তিনি কি রামকৃষ্ণ মিশন চাইতেন? মনে হয় না। আমি কোনো মিস্টিক তথ্যে যাচ্ছি না। কিন্তু তিনি কোনোদিন এই সব তিথি পালনের মাধ্যমে খুব সরলীকরণের মাধ্যমে ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’-এর বার্তা পৌছাতে চেয়েছিলেন? এটা কিরকম সেই রাজনৈতিক কৌশলের মত না? রামকৃষ্ণদেব কিন্তু এরকম কোনো বাহ্যিক সমীকরণে বিশ্বাসী ছিলেন না। এমনকি তাকে মার্কেটিং করতে যে এই ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’-এর ব্র্যাণ্ড করা হয়, এটা সারদাদেবীরও খুব অপছন্দ ছিল। তিনি বলেছেন, কোন মতলব এঁটে উনি এগুলো করেননি, ওটা হয়ে গিয়েছিল, ওনার প্রধান শিক্ষা ছিল ‘ত্যাগ’।
     মিশন কিন্তু সে পথে হাঁটেনি। তারা আমাদের মন্ত্রীদের মত বড়দিনে যীশুর ফটো, শঙ্করাচার্যের জন্মদিনে শঙ্করাচার্যের ফটো, আর বুদ্ধের জন্মদিনে বুদ্ধের ফটো টাঙ্গিয়ে উৎসব করার চেষ্টা করে আসছে। পাশাপাশি কালী-দূর্গা-সরস্বতীও চলছে। আমাদের বোঝানো হচ্ছে, এটাই রামকৃষ্ণদেবের ‘সর্বধর্ম সমন্বয়’; কিন্তু তিনি এত সস্তা পথে হেঁটেছিলেন কি? না। রামকৃষ্ণ মিশনের স্টলে আপনি কোরাণ, বাইবেল, ত্রিপিটক পাবেন কি? না। কারণ রামকৃষ্ণ ‘অবতার-বরিষ্ঠায়’, অর্থাৎ সুপারলেটিভ ডিগ্রি লেগে গেল। তিনি সব অবতারের ফুল প্যাকেজ, প্রচারিত হতে শুরু হল; এমনকি তিনি সব দেব-দেবীর মূর্তির প্রকাশ – তাও প্রচারিত হতে শুরু করল। অর্থাৎ আমাদের বোঝানো হচ্ছে, একটু ঘুর পথে, কে শ্রেষ্ঠ বুঝে নাও। সুবিধা করে দিল কথামৃত – আকবরী আমলের টাকা এখন চলে না, এখন ফিভার মিক্সচার, পাঁচন না – ইত্যাদি উপমারাই রামকৃষ্ণের শিক্ষার উপর পুরো পাথর হয়ে বসল। শেষ পেরেকটা মারল রামকৃষ্ণ মিশনের দীক্ষা পদ্ধতি। সেখানে যতই সর্বধর্মের সমন্বয়ের গল্প শোনানো হোক, মন্ত্র হয় রামকৃষ্ণদেবের নামেই প্রধান, কদাপি সারদাদেবীর নামে। সে আপনার যে দেবতাতেই অভিরুচি হোক। কারণ রামকৃষ্ণই সব – প্রধান। কি ভাবে একটা উদারতার ছদ্মবেশে গোঁড়ামি বাসা করছে দেখুন। ধর্মের ক্ষেত্রে এটাই চিরটাকাল হয়ে এসেছে, old wine in new bottle. তাই এবারের ‘দেশ’-এও যখন সুমন সেনগুপ্ত তার লেখার শেষ লাইন লিখছেন – “শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যেই এর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রকাশ। শ্রীরামকৃষ্ণেই তাই মানবমুক্তি”, আমার কষ্ট হয় রামকৃষ্ণদেবের জন্যেই। এতটাই কি বোকা আমরা? কিসের ছদ্মবেশে কি বিষ গেলানো হচ্ছে বুঝি না? কবীর, শিরডির সাঁই, লালন – এরা কি শিক্ষা দিলেন তবে এই ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে?
     এতেই যত ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেল। রামকৃষ্ণ ক্যালেণ্ডারে এলেন, প্লাস্টার অফ প্যারিসে এলেন, সিনেমায় এলেন - কিন্তু জন-চেতনার গভীরে এলেন না। কারণ তাঁকে নিয়েই যে দল আজ। মঠ আজ। আরেকটা কথা বলে প্রসঙ্গের ইতি টানি – জীবসেবা যতই রামকৃষ্ণের শিক্ষা বলে চালানো হোক, আদতে তা নয়। পুরো কথামৃতই তার সাক্ষী। তিনি প্রাচীন ভারতের প্রধান ধারায় যে ভক্তি-জ্ঞানমার্গের কথা, তার পথচারী। নারদীয় ভক্তি, অদ্বৈতজ্ঞান ইত্যাদির পরিচায়ক, সমন্বয়কারী তো বটেই। একজন ভক্ত যখন সব অর্থ দিয়ে হাসপাতাল বানাবার কথা বলেন, রামকৃষ্ণদেব তাকে বিরত করেন। বলেন, ওসবের জন্য মানুষের জীবন না, তুমি ভক্তিলাভের সাধনা করো। এর অর্থ এই নয় যে উনি সেবার বিরোধী ছিলেন, কিন্তু তাকেই জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য করার পক্ষপাতী ছিলেন কি? ‘জীবেসেবার মাধ্যমেই আত্মার মুক্তি’ এটা পাশ্চাত্যের ধর্মের মূল সুর, যা তার প্রধান শিষ্যদ্বারা প্রচারিত। একসময় মঠে এই নিয়ে মেলা সমস্যাও হয় গুরুভাইদের মধ্যে। সারদাদেবী একটা মধ্যস্থতা করেন।
     তাই মনে হয়, আদতে রামকৃষ্ণদেব বলতে যা বুঝি তা দক্ষিণেশ্বরের ঘরে গেলে কিঞ্চিৎ আভাস মেলে। তার নামে যে মিশন সে একটা পাঁচ-মিশালী সুকৌশলী প্রতিষ্ঠান। মোড়কটা অত্যন্ত উদার, ভিতরে তাই কি? সেইখানেই হল বিভ্রান্তির চূড়ান্ত। সত্যের যে জোর, কৌশলের সে জোর কি আছে?
     ‘Fact’-এর ব্যাখ্যা বদলে দিলে মাঝে মাঝে তা ‘আলোকে যে লোপ করে খায়, সেই কুয়াশা সর্বনেশে’ হয়ে ওঠে। আমার মনে হয় রামকৃষ্ণদেবের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। কোথায় যেন একটা গোঁজামিল।

 মনের কথা(৬)
চিঠি
সুরাইয়া বেগম

 অভিমানী,
আজকাল কেউ আর চিঠি লিখেনা । উতল মনে কেউ আর থাকেনা চিঠির প্রতীক্ষায় । একটা সময় ছিলো যখন হোস্টেলে থাকতাম- উদগ্রীব হয়ে থাকতাম এই বুঝি ডাকপিয়ন ডেকে বলবে- ২২ নম্বর রূমের চিঠি এসেছে । নারে , আজকাল মানুষ ভুলেই গেছে চিঠি লেখার কথা । কেন লিখবে বল- ইচ্ছে করলেই মুঠোফানে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলা যায়, ফেসবুক ইনবক্সে চুটিয়ে আড্ডা দেয়া যায় । তবুও মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে শুয়ে শুয়ে চিঠি পড়ি । কাউকে দু' কলম লিখি মন খুলে । আজ তোকেই লিখছি । পড়িস সময় করে ।
কতগুলো বসন্ত চলে গেল জীবন থেকে , তাই নারে ! মনে হয় এইতো সেদিন জন্মেছিস । মেঘনার তীরে - আমাদের বাল্যস্মৃতির সবটুকুন নিয়ে যেই বাড়িটি চিরদিনের মতন তলিয়ে গেল , সেই বাড়িতে তোর জন্ম। ঠিক কোন এক বছরের এই দিন সন্ধ্যায় তোর জন্ম হলো । ছোট্ট ছোট্ট দুটো হাত, দুটো পা , ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা ছোট্ট একটা মানুষ ! কি বিস্ময় , কি বিস্ময় ! ছোট্ট আমি নেড়েচেড়ে দেখি তোর হাত , ধরে দেখি তোর পা । আহা ! এতো ছোট বুঝি মানুষ হয় ? একটু ক্ষিধে পেলেই চিৎকার করে ওঠে ওই ছোট্ট মানুষ ! ভীষণ ভড়কে যাই ছোট্ট আমি । সেই পুঁচকে মানুষটা বড় হতে লাগলো আমার হাত ধরে । খুব শখ করে কোলে নিতে চাইলে - বড়রা কেউ খাটে আমাকে বসিয়ে দিতো । তারপর তোকে আমার কোলে তুলে দিতো । ছোট্ট তুই আমার কোলে হাত পা নেড়ে জানান দিতি তোর অস্তিত্ব ।
খুব অভিমানী ছিলি সেই ছোট্টবেলা থেকে । বাবা তোকে ডাইনিং টেবিলের কোণায় তার বা পাশে তুলে বসাতেন । তারপর প্লেটে ভাত মেখে তোকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন । ভীষণ আহ্লাদী ছিলি , কথায় কথায় মুখ ভার হয়ে যেত । মাঝে মাঝে খাবার টেবিল থেকে উঠে চলে যেতি না খেয়ে । তোর উঠে যাওয়া দেখে বাবারও যে খাওয়া বন্ধ হয়ে যেত ! আম্মা খুব একটা পাত্তা দিতেন না এসব রাগের । বলতেন- ক্ষিধে পেলে ঠিক খাবে ।
একবার কি হলো তোর মনে আছে ? মেঘনা নদী দেখতে যাবো বলে পুরো একটা পুঁচকের দল নানা বাড়ি থেকে রওয়ানা করলাম । আমাদের সাথে তুইও আছিস । তুই সাঁতার শিখিস নি । পানিতে তোর ভীষণ ভয় ! অথচ সেই মানুষ কিনা সবার সাথে চললো নদী দেখতে ! আমরা বাকিরা সবাই সাঁতার জানি । হাঁটছি তো হাঁটছি ! হঠাৎ সামনে পড়লো ছোট্ট একটা খাল । খালের উপর বাঁশের সাঁকো । সেই সাঁকো পেরিয়ে নদী বুঝি আর দেখা হবেনা আমাদের ! সাঁকো তো পাড় হওয়া সম্ভব নয় ! ওতোদূর পথ যেয়ে ফিরে আসবো , সবার খুব মন খারাপ হলো । শেষে একটা সিদ্ধান্ত হলো- নৌকা দিয়ে আমরা খালটা পার হবো । সবাই নৌকায় উঠে বসলো । মাঝি নৌকা অন্যপাড়ে ভিড়াবার আগেই পুঁচকের দলের কেউ একজন লাফঝাঁফ দিয়ে টালমাটাল করে দিলো নৌকা । সবাই চিৎকার চেঁচামেচি করে উঠলো ভয়ে । আমি তো ভীষণ ভড়কে গেলাম ! তুই সাঁতার জানিস না । চিৎকার করে কাঁদতে লাগলি। পানিতে পড়ে গেলে ঠিক ডুবে যাবি । তোকে তো আর খুঁজে পাবোনা । তোকে হারানোর ভয়ে লাফ দিয়ে আমিই পানিতে নেমে গেলাম । দু' হাত দিয়ে শক্ত করে নৌকাটা ধরে রাখলাম । কোন রকম সেই যাত্রায় রক্ষা পেল নৌকা । তীরে ভেড়ানো হলো । সবাই নৌকা থেকে নেমে গেল । আমি ভেজা শরীরে তোকে জড়িয়ে ধরলাম । সেই দিনের মতন ভেস্তে গেল নদী দেখা । প্রচন্ড শীতে ভেজা কাপড়ে কাঁপতে কাঁপতে ভয়ে ভয়ে বাড়িতে ফিরলাম- না জানি আম্মা বুঝি আজ মেরেই ফেলবেন ! কিন্তু না । আম্মা দুজনকেই কাছে টেনে নিলেন । একটুও বকলেন না আমাকে ।
যেদিন ছোট ভাইটার জন্য সাইকেল কেনা হলো - কি যে আনন্দ আমাদের পুরো পরিবারে । দুই চাকার সাইকেলে আরো দুটো সাহায্যকারী চাকা । তাই নিয়ে তুমুল হুটোপুটি । কিছুক্ষণ তুই চালাস, কিছুক্ষণ ভাই চালায় । আস্তে আস্তে সাহায্যকারী চাকাদুটো ভেঙ্গে গেল । কি মুশকিল ! এখন আর তোরা দুজন সাইকেল চালাতে পারিস না । তোদের সাইকেল চালানো শেখাবার দায়িত্বটা আমিই নিলাম । সিটে বসিয়ে পেছন থেকে সাইকেল ধরে রাখি । তুই চালাতে থাকলি , আমি সাপোর্ট দিয়ে গেলাম । বলতাম- সামনে তাকিয়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে যা , আমি ধরে আছি । তুই প্যাডেল মেরে যেতি - জোরে ছুটতো সাইকেল । আমি পিছনে পিছনে দৌড়ে দৌড়ে একসময় ছেড়ে দিতাম । তুই ঠিক চালিয়ে যেতিস নির্ভয়ে । কারণ তুই জানতি- তোর পেছনে তোর বড় বোন তোকে ধরে আছে, কিছুতেই তোকে পড়তে দেবেনা । যাতে সাইকেল থেমে গেলে ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে না যাস তাই দৌড়ে দৌড়ে তোর সাইকেলের সাথেই থাকতাম। একদিনেই শিখে ফেললি সাইকেল চালানো । তোকে, ভাইকে আমি সাইকেল চালানো শিখিয়েছি- অথচ দেখ ! আমি নিজে সাইকেল চালাতে জানিনা । খুব আফসোস হয় আজ !
কত কিছুই না আজ মনে পড়ছে ! নারে সব লিখতে গেলে রাত ভোর হয়ে যাবে । যেদিন তুই বেনারসি জড়িয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলি- আমার বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল । সারারাত এক ফোটা ঘুমাইনি আমি । রান্না ঘরের জানালা ধরে কত দিন যে অঝরে কেঁদেছি ! ঘরের ভেতরটা শূন্য হয়ে গেল । আমিও সব কিছুর মাঝে কেমন নিঃসঙ্গ হয়ে গেলাম ।
এখনো কি সেই রকম অভিমানী আছিস ? একটু দুঃখ পেলে কেঁদে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলিস ? বুঝিরে ! সন্তান লালনপালন, সংসারের ঝক্কি ঝামেলা সামলে কখন আর অভিমান করবি ? হয়তো যখন বারান্দায় বসে থাকিস কোন একলা বিকেলে অথবা বৃষ্টিভেজা কোন সন্ধ্যায় - চোখের সামনে ঠিক শৈশব এসে ডানা ঝাপটায় । তাই নারে ? হয়তো মেঘনার অতলে হারিয়ে যাওয়া নানা বাড়িটা - যেটা আমাদের দু' জনেরই জন্মস্থান , খুব মনে পড়ে । ভালো থাকিস, খুউব ভালো ।
আপু

রম্য রচনা
গুরুত্ব
প্রদীপ গুপ্ত

কারা যেন তাদের গুরুত্ব নিয়ে খুব চিন্তান্বিত থাকে। বেশী বেশী করে  নিজেদের উপস্থিতির প্রদর্শন করে বোঝাতে চায় তাদের অপরিসীম গুরুত্বের কথা। তুমি ধরো ফুলের দোকানে দাঁড়িয়ে আছো, ফুল নেবে বলে, ধরো তোমার সামনে আরও জনাকয়েক মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। দোকানি এক এক করে সব্বাইকে কার গাঁদা ফুলের মালা লাগবে, কার রজনীগন্ধার, কার আমসরা লাগবে তো কার পান আর কলা, সেসব জনে জনে জিজ্ঞাসা করে ক্যারিব্যাগে ভরে এগিয়ে দিচ্ছেন, এমনি সময় তিনি এলেন,
" কিরে স্যপন্ আজ কি দেরি করে এস্যেচিস নাকি? এত্তো লোক দাঁড়িয়ে লাইনে? "
দোকানি তার কাজ করে চলেছেন, মানুষজনেরা তাদের মতোন দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি হামলে পড়লেন দোকানে। একটা আমসরার বান্ডিল খুলে চারিদিকে ছড়িয়েছিটিয়ে নিখুঁত পল্লব বাছতে লাগলেন।বেলপাতার ডাল থেকে বেলপাতা ছিঁড়ে নিয়ে খালি ডালটা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেদের দিকে ফেলে ডায়লগ দিলেন -
" নে নে, -- তাড়াতাড়ি দেতো , দশটার ভেতর আবার অপিস ঢুকতে হবে, এইনে -"
                  বলে হাতে ধরা বেলপাতা, আমপাতা এগিয়ে দিলেন। মানুষজন একটু এ ওর দিকে তাকালেন, মুখ থেকে চুকচাক শব্দ করলেন, কেউ একটু বদন বেঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসার চেষ্টা করলেন, দোকানি হাত বাড়িয়ে পাতাগুলো নিতে যেতেই একজন মানুষ ঠান্ডাকঠিন গলায় বলে উঠলেন --" স্বপন, লাইন অনুযায়ী দাও, এখানে কেউ ঘোড়ার ঘাস কাটতে আসেনি। সব্বারই হাতে কাজ আছে, তাড়া থাকলে কাল সকাল সকাল আসতে বলো। "
লাইনটা একটু নড়েচড়ে উঠলো। মুখ বাঁকানো লোকটা অস্ফুটে কিছু একটু বললেন, দোকানী র হাত ফের আগের মতই চলতে লাগলো।

             একদিন বাজার করে ফিরছি রাস্তায় মুকুন্দের সাথে দেখা। আরে সেই মুকুন্দ যে আমাকেও তারই মতো পাগল না ভেবে তার মতোই সুস্থ মানুষ মনে করে।
--" কি একটু ঠান্ডা পড়ছে মনে হচ্চে? "
আমি শুধোই।
--" তা একটু তো বটেই। এখন অর্জুনগাছের ছাল ফাটতে শুরু করবে বুঝেছো? "
--" তাই? "
আমি উত্তর করি। যেন একটা খুব গূঢ় কথা বলছে এভাবে সামনে এগিয়ে এলো মুকুন্দ --
" সূর্যটা দেখবে এখন একটু ইচ্ছে করেই মিঠেকড়া রোদ ঢালবে, যেমনি গ্রীষ্মকালে শীত ডানা মেলে সাইবেরিয়া পালায়, আসলে প্রকৃতিও জানেন কাকে কখন কতটুকু গুরুত্ব দিতে হয় বুঝেছো? "
-- " তুমি বলবে আর আমি বুঝবো না? "
আমি হাঁদারামের মতো মাথা নেড়ে তাল মারি।
--" এই আমি চলি বুঝেছো? আমার আবার --"
বলে মুকুন্দ হনহন করে হাঁটা লাগায়। আমি পরিস্কার বুঝতে পারি মুকুন্দও তার গুরুত্ব বুঝেই হাঁটা লাগালো। আমি হাঁ করে তার চলে যাওয়ার গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করি।

অনুগল্প

শিরদাঁড়া
দিব্যায়ন সরকার


“ আলো - আঁধারির খেলা, তীব্র উৎকট দুর্বোধ্য গান আর বিলিতি মদের উগ্র গন্ধ - সব মিশিয়ে একটা অদ্ভুত পরিবেশের মধ্যে চিত্রার্পিতের মত দাঁড়িয়েছিল সৌমেন। সমস্ত ডিস্কো বারটা যেন বিদ্রুপ করছে তাকে ! অ্যালকোহল বারৈর সুদৃশ্য কাউন্টারের ওপারে সুন্দরী অ্যাটেন্ডার, তারও ওপারে দামী মদের বোতলগুলো - সবাই মিলে একসঙ্গে চতুর্দিক থেকে চেপে ধরছে তাকে।

এই ডিস্কো ব্যাপারটার সঙ্গে প্রথমবার পরিচয় সৌমেনের। মফঃস্বলের ছেলে চাকরি সূত্রে ব্যাঙ্গালোরে আর বন্ধু সূত্রে এখানে। গৌরব আর শ্যামানুজের চাপাচাপিতে কিছুটা কৌতুহলি হয়েই এসেছে। গৌরব আবার বদান্যতায় তার ভাড়াটাও দিয়ে দিয়েছে ঢোকার সময়। এক রাতের ফুর্তির জন্য অতগুলো টাকা ঢেলে দেওয়া দেখে কিছুটা শিউরেছিল সৌমেন, কিন্তু টাকাটা তার পকেট থেকে যায়নি জন্য চেপে গিয়েছিল। দরজা দিয়ে ঢুকতেই অ্যালকোহল, সোডা আর রকমারি পারফিউমের ঝাঁঝালো গন্ধে নাক কুঁচকে গেলেও সহ্য করে নিয়েছে।

ঢোকার পর হয়তো মিনিট পাঁচেক বসেছে একটা টেবিলে, হঠাৎ দুজন 'স্বল্প বসনা'র আগমন। গৌরব ও শ্যামানুজের সঙ্গে বেশ রসিয়ে গল্প শুরু করেছিল। কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছিল তারা পূর্বপরিচিত। সৌমেনের সাথে পরিচয় করিয়েছিল শ্যামানুজ। কিছুক্ষণ সৌমেনকে আগপাশতলা মেপে একটা অর্থপূর্ণ হাসি হেসেছিল দুজনে। সৌমেন প্রথমে কথা বলেছে দু একটা, তারপর নিজেই আগ্রহ হারিয়েছে।

বারের সামনে দাঁড়িয়ে ড্যান্সবারের দিকে তাকিয়েছিল সৌমেন।  তার দুই বন্ধুকেই চোখে পড়ছে, দুই সুন্দরীর কোমর জড়িয়ে নেচে যাচ্ছে দু'জনে। কিছুটা দেখেই চোখ ক্লান্ত হয়ে গেল, বুঝে এল ধীরে ধীরে।

আচমকা পিঠে এক আলতো টোকায় ফিরে দাঁড়াল সৌমেন। উজ্জ্বল নীল দুটি চোখ যেন গিলে খেতে চাইছে তাকে। বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যাবেনা।  চোখ দুটির মালকিন আরও কিছুটা সরে এসে নাকিসুরে প্রশ্ন করে -
- “ আর ইউ সিঙ্গল ? ”
বিভ্রান্ত লাগে সৌমেনের। এতটা কাছ থেকে অচেনা এই অল্প পোশাক পরিহিতাকে দেখে কিছুটা থ' খায়। চোখে মুখে উগ্র মেকআপে, পারফিউমের জ্বালাময়ী গন্ধে দিশেহারা লাগে তার।
- “ হোয়াট ডু ইউ মিন বাই ' সিঙ্গল' ?  আই কেম হেয়ার উইথ টু অফ মাই ফ্রেন্ডস।”
বেগুনি ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি এসেই মিলিয়ে গেল, যেন বলতে চাইল - 'ন্যাকা !  বোঝে না কিছুই।'  কিন্তু দ্বিতীয় কথাটি বলার আগেই গৌরবরা এসে পড়ল সদলবলে।
- “ ওহ রিমলি ইউ আর লুকিং গরজিয়াস টুডে।”
উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ঝড়ে পড়ল শ্যামানুজের গলায়। “ ইউ মেট সৌমেন? মাই ফ্রেন্ড অ্যান্ড কলিগ।”
সুতীক্ষ্ণ কটাক্ষের দৃষ্টিতে সৌমেনকে আর একবার মেপে নেয় রিমলি। তারপর পরিস্কার বাংলায় বলে,
- “তোমাদের এই খোকাটি তো কিছুই নিচ্ছে না। তাই আমিই এগিয়ে এলাম মানুষ করতে।”
হো হো হাসির হুল্লোরে ভেসে যাচ্ছে ওরা। সৌমেন কিছুই বলল না। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের একনিষ্ঠ পাঠক, চারপাশের পরিবেশ থেকে লক্ষ যোজন দূর তার দুনিয়া।
- “ কাম অন সৌমেন, এবার একটা হুইস্কি নিতেই হবে কিন্তু। মান বাঁচাতে।”
গৌরবের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল একবার সৌমেন। তার দিকে এগিয়ে আসা হাতের গ্লাসটিতে সোনালী তরল। হাতের আঙুলগুলির বাঁকানো ভঙ্গী, নখ থেকে ঠিকরে আসছে নেলপালিশের নকল রঙ। সাদা ফ্যাকাশে হাতে একটা দামী সোনার বালা। সৌমেনের হঠাৎ মনে হল ঐ রঙটার মতো এই দুনিয়াটাও নকল। বিরক্তর ভঙ্গিতে ঠেলে গ্লাসটিকে সরিয়ে দিল এক ধাক্কায়।
- “ লেট ইট গো গৌরব, অনেক আগেই বুঝেছি তোমাদের বন্ধুটি পুরোপুরি অক্ষম।”
আর একবার হাসির লহরে ভেসে যায় ওরা। গৌরব - শ্যামানুজও গলে পড়ে। হাসি থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করল গৌরব। তারপর স্থির অথচ দৃঢ় গলায় বলল,
- “ আমার অক্ষমতা ক্ষমা করিস গৌরব। সত্যি আর পারছি না দাঁড়িয়ে থাকতে। আর আমার মান এত সহজে যায় না আর তা রাখতে মদ গিলতেও হয় না।  ইউ এনজয় ইওর পার্টি। থ্যাংকস। ”
মাথা উঁচু করে সোজা হেঁটে বেড়িয়ে যায় সৌমেন। বাকিদের বিদ্রুপ করা দৃষ্টিগুলি পেছনে ফেলে রেখে..... ”

  না ! কেন জানি না গল্পগুলো আর মিলছে না অপ্রতিমবাবুর। বইমেলা সংখ্যায় এত এত লেখার অনুরোধ কিন্তু আজব ব্যাপার দুধের মতো গল্পগুলোকে ক্ষীর আর করা যাচ্ছে না। শেষে এসে কেমন ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে । তাহলে কি মা সরস্বতী  তার ওপর রুষ্ট, না তার সমস্ত লেখা ফুরিয়ে গেছে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে মীরাকে এককাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে দিলেন অপ্রতিমবাবু। নতুন উদ্যমে আবার শুরু করতে হবে যে।

কবিতা

সিন্দুক
বিশ্বজিৎ মাইতি

ঘূর্ণাবর্তে ধুয়ে গেল আরো একটা চাঁদ,
মন খারাপের গল্পটা আজ তবে থাক।
সিন্দুকে কটা অক্ষর তুলে রেখেছি,
চলো বরং তোমাকে গিয়ে দেখাই-
এই দেখো বাদামি রঙের অক্ষরগুলো,
অনেকটা ঠিক ঝরে যাওয়া মেইপল পাতার মতন দেখতে,
তাই না?
তুমি চাইলে ছুঁয়ে দেখতে পার,
আজ বিকেলে পথের ধারে কুড়িয়ে পেলাম আবার কয়েকটা-
ওদের নাম দিয়েছি অবসাদ।
ওই কোণে লাল দোয়াতের পাশে রাখা অক্ষরগুলো
তুমি দেখতে চেয়ো না,
ওগুলো গোছানো হয় নি এখনো।
ভেবেছিলাম তোমাকে নিয়ে ‘শেষের কবিতা’ লিখব,
দেখো তোমার দেওয়া ঝর্ণাকলম হলুদ মলাটের খাতা
সব গুছিয়ে রেখেছি,
ওরা আমার অভিমান।
চোখ বন্ধ করে এবার হাত রাখ এখানে-
তোমার শীত করছে বোধ হয়,
শুনতে পাচ্ছ,
সরবতি লেবুর কচি পাতা বেয়ে
ঘাসের উপর গড়িয়ে পড়ছে হেমন্তের শিশির-
হরিণ শিশুর দল সানন্দে ছিঁড়ে খাচ্ছে সেই সুগন্ধি ঘাস,
বড় অদ্ভুত তার স্বাদ।
দেখেছো তোমার জানালার ফাঁকে
রোদ মেখে চেয়ে আছে অপলক
দুটি আকাশ রঙের ঘাস ফুল,
দেখেছো কি?
ও দুটি এই অধমের আঁকা,
ওদের নাম রেখেছি সুখ।

সন্তান
জগন্নাথদেব মণ্ডল

হীরাসায়রের অতল জলে গর্ভপাত হয় রাঙাবৌয়ের।নাকে নথ পরা কালবোশ মাছ নাড়ির বাঁধন ছিঁড়ে দিয়েছিল।পাঁকের নীচে তলিয়ে যায় সদ্যোজাত সন্তান।
জাল ফেলেও খুঁজে পাওয়া যায় নি।

রানিদি রাঙাবৌয়ের বড়ো মেয়ে।দিদি সারারাত মরা জ্যোৎস্নায় গা চুবিয়ে 'ভাই ভাই' করে কেঁদে মরেছে হীরাসায়রের পাড়ে।

মৃত সন্তানটির পুরুষাঙ্গ মিশে গিয়েছে গেঁড়ি- গুগলির চোখের জলে।ওই গুগুলি ঠুকরে খায় হলুদ পায়ের ধলা হাঁস।

পুরুষাঙ্গ বাদে  কাদায় ঢাকা পড়া  নতুন নাভি অার নাসারন্ধ্র থেকে জন্ম নয় শাপলা ফুল।কুড়ানী মাসি ওই শাপলা ফুল দিয়ে ঢ্যাপের খই ভেজেছে।

রানিদি কোঁচড় ভর্তি খই নিয়ে দত্তদের বাড়ি চলে গেছে।ওদের সাদাকালো টিভিতে ' জন্মভূমি' দেখতে দেখতে মুঠো মুঠো ভাই-খই খাবে রানিদি।

সন্ধ্যের অাঁধার যেন প্রসব যন্ত্রণায় চুপ।সন্তান শোক অতিক্রম করা, স্থির রাঙাবৌ হাঁস তুলতে এসেছে হীরাসায়রের কিনারে।বৌয়ের একঢাল চুলে ছোট্ট একটু গিঁট বাঁধা।

সন্তানস্পর্শ মাখা গুগলি খেয়ে পেট ভারী হয়ে গেছে হাঁসগুলোর।কিছুতেই উঠে অাসছে না হলদে পায়ের ধলা হাঁস।

জলের ভেজাভেজা বাতাসে শুধু মৃত পুত্রের ঘ্রান।কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে রাঙাবৌয়ের চৈ চৈ ডাক।
জলপাই গাছ পেরিয়ে বুড়ো পিটুলি গাছের পাশ দিয়ে স্নান করতে অাসছে মালোপাড়ার গর্ভবতী লবঙ্গবউ।

   


  ফ্যাসিস্ট
  আর্যতীর্থ

দাও, পিষে দাও, চাপ দাও আরো।
ঘাড় গুঁজে দাও যতখানি পারো।
এদিকে ওদিকে সাবধানে দেখো, প্রশ্নরা কার চোখে।
কিভাবে সে জিভে লাগাম টানবে আগে থেকে ফেলো ছকে।

আভূমি করছে কুর্নিশ যারা,তারাই কেবল প্রজা। বাকিরা সবাই বিপজ্জ্বনক, নীতি এ সাপ্টা সোজা। তোমার খেয়ালে তালে তাল দিলে সেইজন ভারী প্রিয়। বিরুদ্ধমত অন্ধকূপের আঁধারেই রাখা শ্রেয়।

শিরদাঁড়াটির বদলে চেয়েছো কেঁচো ।
সঙ্গী সাথীও সেভাবেই বেছেছো।
অষ্টপ্রহর গুণকীর্তণে ভরিয়ে রেখেছো ঘর।
স্বভাবত তাই বিরোধীকণ্ঠ স্বপ্নের অগোচর।

অথচ সেসব দোষারোপ নয়, ছিলো শুধু অভিযোগ। দিনগত পাপে নিত্যকালের লেগে থাকা দুর্ভোগ।
সে সব নালিশ লেগে থাকে সব যাপনের ভাঁজে ভাঁজে। খামোখা তাদের চেপে রেখে দিলে তোমার হুকুমরাজে।

সিংহাসনকে জীবন ভেবেছো, স্বয়ংকে ভগবান।অমৃতজ্ঞানে তাই ভালো লাগে ক্ষমতার বিষপান। বিরোধী কথাকে বিদ্রোহ ভেবে পায়ের তলায় পেষো। কবে ভুলে গেছো সত্য মিথ্যা যাচাইয়ের অভ্যেসও।

বড্ড দুঃখ, ইতিহাস পড়ো নি।
আঁধারের দিকে গিয়েছে ও সরণী।
সত্যি জানাবে কখনো তোমায় আয়না ।
সব শিরদাঁড়া ওভাবে নোয়ানো যায় না।


শুধু তোমার লেখার অপেক্ষায়
প্রত্যূষ কান্তি কর্মকার

কিছুই যদি না লেখা যায় তবে আবার বৈঠা ধরো কবি
পালের ডগায় বাতাস ভরে ঢেউয়ের সাথে মিতালী করো
যেমন ভাবে বইবে তোমায় তেমন তেমন ভাসতে থাকো,বাঙ্ময়তায় ভরিয়ে তোলো বেঁচে থাকার দিগন্ত রঙ,মুহূর্তের অবিন্যস্ত দীঘি
আমার সুন্দর নদীর পাহাড়িয়া জল তল পাবে বলে লাফিয়ে লাফিয়ে নেমেছে
তোমার নৌকো বাওয়া সাগরের কাছে,ভাবি
মিটে যাবে বহু বছরের অবিশ্রান্ত জমে ওঠা ঋণ
তোমার বুকের ভেতরে ফানুসের মত কূল আলোময় ভেসে থাকে
জেগে থাকে একশ পাতার কলকাকলি, হাজার পাতার ছল,দূরে বসে দেখতে দেখতে
দুঃখ আর মায়ার ভরে যায় বিকেলের গোধূলি রঙিন হাত
হলুদ ঠোঁটের থেকে প্রয়োজন ঝরে যায় ধূ ধূ শোওয়া মাঠের কোণায় কোণায়
আমি প্রতি বসন্তে জমিয়ে রাখা রাত্রির কণা জুড়ে গড়ে ফেলি দীর্ঘ উঠোন
শুধু তোমার লেখার অপেক্ষায়,কবি,আমার অঙ্গনে সন্ধ্যার ধূপের গন্ধ ওড়ে না

মাথুর
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার

বনপলাশীর বনে তোমার ছাতিম গন্ধ মনে পড়ে
এখনি কি ফিরে যাবে হৃদি?
ছন্নদেহ বসে আছি বিষণ্ণ বনে
দূরাগত আমার বঁধুয়া,
আতুর পাখিটি দেখ ডাক দিল কার নাম ধরে
কাঁখের কলসে ভরে আকুলা নদীটি ঘরে গেল
অতসী অমিয়মাখা মুখখানি আহা
গ্রামের বধূটি,পায়ে চুম্বনের দাগ
কবে তুমি ডাক দেবে
দেহি পদ পল্লব বলে...

Friday 22 December 2017

ডিসেম্বর ২০১৭,দ্বিতীয় পাক্ষিক


 

 সম্পাদকীয়

এখন পৌষ। সাহিত্য এখনের চতুর্থ সংখ্যায় অবশ্য শীতের কোন গন্ধ নেই। বরং কোন কোন লেখায় ক্রমবর্ধমান রোষের আঁচ টের পাওয়া যায়। জানিনা এই আঁচ আদৌ জীর্ণতাকে পুড়িয়ে দিয়ে নূতন স্বচ্ছতাকে ডাক পাঠাতে কতটা সক্ষম হবে। তবে আশা করতে দোষ কি?

 এই সংখ্যা প্রকাশে একটু দেরী হয়ে গেল। তার জন্য মার্জনা চেয়ে নিচ্ছি। আশা করি সংখ্যাটি আপনাদের ভাল লাগবে। ভাল কাটুক বছরের বাকি দিনগুলো।

মনের কথা(৩)

দেবশ্রী মিত্র

আমাদেরও ছোটবেলা ছিল। আমরা যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। জেঠতুতো, পিসতুতো দাদা, তাদের বন্ধু, মায়ের খুড়তুতো ভাই, কেউ আমাদের মলেস্ট করে নি। আমরা অনায়াসে পিতৃবন্ধুর কোলে চেপে তার বাড়ি গেছি, থেকেছি, খেয়েছি, ঘুমিয়েছি, কেউ আমাদের রেপ করে নি। আমার এক শিক্ষক ছিলেন, তিনি তাঁর এক বন্ধুকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। না বলায় আর কোনদিন সে কথা তোলেন নি। তাঁর কাছে তার পরেও পড়েছি, কোনদিন আলাদা করে ডেকে কথা অবধি বলেন নি। রেপ, মলেস্টেশন কী তবে মোটেই হত না? হত তো বটেই, তবে সংখ্যা অনেক কম ছিল। বাবা-মা, পরিবারও চেপে যেত, তবু সংখ্যা কম ছিল। আমি, ক্লাস থ্রি থেকে নিয়মিত খবরের কাগজ পড়া মেয়ে, প্রথম ধর্ষণ শব্দ পড়ি রাজনৈতিক দেওয়াল লিখনে। মনে আছে, কারণ স্কুলে যেতে যেতে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আর বাবা আমার বয়সের যোগ্য ভাষায় মানে বুঝিয়ে দিয়েছিল। তবে হঠাৎ আমাদের কী হল? আমাদের মধ্যে হঠাৎ করে এরকম ধর্ষণ, যৌন অত্যাচার বেড়ে যাওয়ার কারণ কী? এমনকি শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। এরা সব রাতারাতি কোথা থেকে এল? এক জেনারেশনে আমরা এত ধর্ষক আর ধর্ষকামী মানুষজন পয়দা করে ফেললাম?

উত্তরটা হচ্ছে হ্যাঁ। এক জেনারেশনে আমরা অর্থনৈতিক ভাবে স্বচ্ছল হয়েছি, টেক-স্যাভি হয়েছি, ঘরে ঘরে ফোন, নেট, দুনিয়া আমাদের মুঠিতে, আর আমরা মানুষ হিসেবে পিছিয়েছি অনেক যুগ। আমাদের সমস্যা ভারী টিপিক্যাল। ছোটবেলায় পড়া এক রাজা আর তার বাঁদর রক্ষীর মত। রাজা ঘুমোন, তাঁর অতি বিশ্বস্ত বাঁদর রক্ষী হাতে তলোয়ার নিয়ে পাহারা দেয়। রাজার গায়ে মাছি অবধি বসতে দেবে না সে। এক মাছি এসে বসে রাজার গলায়, বাঁদর বড় ভালো রক্ষী, রাজার গায়ে মাছি বসা সহ্য হয় না তার। তলোয়ার তুলে কোপ বসায় রাজার গলায়। আমাদের হচ্ছে এই দশা। ফ্রি মার্কেটে আমরা জীবনসাথী ডট কম পেলে ছেলেপুলের বাবা মা তাতে অ্যাকাউন্ট খুলে ব্যাঙ্গালোর নিবাসী অতি আধুনিক ছেলের জন্য অ্যাড দেন, সুশীল সুশিক্ষিতা ফর্সা সুন্দরী গৃহকর্মনিপুণা দেবারি গণ শান্ডিল্য গোত্রের পাত্রী চাই। আধুনিক পরিবার। দাবী নাই। ফেসবুক হাতে পেলে গ্রুপ খুলি ক্যালকম আর পেজ খুলি বাঁকুড়া মীমস। আমাদের অতি সুভদ্র কন্যা সন্তানের পিতা ফেসবুক সেলিব্রিটিরা কোন মহিলার কজন কাস্টমার আর কোন মহিলার বুকের মাপ কত বড়, তাই নিয়ে প্রকাশ্যে স্ট্যাটাস দেন। সেখানে "রবীন্দ্রনাথের গান" পেজ লাইক করা লোকজন হ্যাহ্যা হিহি করতে যান। আমাদের লাইফ খিল্লিময়, অল উই ওয়ান্ট ইজ খিল্লি। আমাদের দুশো চ্যানেলওয়ালা টিভিতে সিরিয়াল হয়, প্রোটাগনিস্ট একসাথে চারটে বউ রাখেন, বাড়ির মেয়েরা এর ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন, আর বরের হাতে মার খান। আমাদের শিশুরা স্কুলের প্রোগ্রামে আর পাড়ার ফাংশানে "শীলা কি জওয়ানি"র সাথে নাচে, আমরা তা স্মার্ট ফোনে রেকর্ড করে প্রভূত আনন্দ পাই। আমাদের ছেলেমেয়েরা বিভূতিভূষণ পড়ে না, বিকেলবেলা মাঠে গিয়ে বল পেটায় না, তাদের খালি নম্বর পাওয়ার তাড়া। আমাদের ছেলেমেয়েরা সবাই ফার্স্ট হয়। ভালো স্কুলে পড়ে। কেউ গল্প বলতে জানে না।

মোট কথা, আমরা রয়ে গেছি সেই ছুঁচিবাই পুরুষতান্ত্রিক পিসীমা, কিন্তু হাতে পেয়েছি সব আধুনিক অস্ত্র। আমাদের ছেলেরা আর ভয়ে ভয়ে নুন শোয়ে গিয়ে যৌনতা চেনে না, স্মার্ট ফোনের বাটন টিপলেই তা তার হাতের মুঠোয়। কিন্তু তাকে একথা শেখানোর কেউ নেই যে, যৌন সম্পর্ক শুধুমাত্র পারস্পরিক কনসেন্টের ভিত্তিতে হওয়া জরুরী। কারো অনিচ্ছায় তাকে ছোঁয়া অপরাধ। শিশুকে নিয়ে যৌনগন্ধী মিম বানানো অপরাধ। কারণ এসব অসভ্য কথা আমাদের সমাজে বাবা মায়ের বলার নিয়ম নেই। কাজেই ছেলে শেখে, বাঁকুড়া মীমের শিশুর ক্লিভেজই স্বাভাবিক যৌনতা। বড় হয়ে আরো বড় হনু হয়, কার স্তন ছবিতে কোন নায়িকার মত দেখাচ্ছে, তার চর্চা করে। আর এরা সব তাবড় তাবড় লোক, হ্যাঁ? ভারচুয়াল সমাজের মাথা। এই হচ্ছে সময়, এই হচ্ছে সমাজ।

আমার ছেলে হাতে কমপ্লেক্স সিনডাকটিলি নিয়ে জন্মেছিল। তাকে বহু ডাক্তার দেখিয়েছি আমরা। বেশিরভাগই এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছেন "সোনার আংটি আবার ব্যাঁকা?" মানে এটি তাঁদের কাউন্সেলিং এর অঙ্গ বলে তাঁরা মনে করেন। আমাদের শিক্ষা আমাদের মেয়েদের সমান বলে ট্রিট করতে শেখায় না। আমাদের বাবা মা আমাদের সুস্থ যৌন শিক্ষা দিতে লজ্জা পান। আমাদের কোন অবসর নেই, সেই অবসরে স্বপ্ন দেখতে শেখার চাবি হাতে তুলে দেওয়ার কেউ নেই। আমাদের যৌথ পরিবার নেই। যেখানে আমরা বৌদি-দেওর, ভাই-বোন বলেও যে সম্পর্ক হয়, তা শিখবো। আমাদের বৌদি মানে তাই দুপুর-ঠাকুরপো। বন্ধুর বোন মানে নীতু সিং। তার মেয়ে মানে আয়েষা টাকিয়া।

আমাদের এইই নিয়তি।


পুনঃ সমাধান চাইলে নিজে শোধরান আগে। নোংরা পেজ, নোংরা গ্রুপ, নোংরা মানুষ, নোংরা সঙ্গ, এদের তোল্লাই দিয়ে নিজের সন্তানের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা যায় না। যায় নি কোনদিন। আর হ্যাঁ, বাচ্চারা শেখালে শেখে না। আপনার ব্যবহার দেখে শেখে। এটা পরীক্ষিত ইউনিভার্সাল সত্যি। আপনি যিনি চারবেলা মহিলাদের চরিত্র নিয়ে খিল্লি করা পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করেন, যিনি বউ পেটান, যিনি সুযোগ পেলেই "মেয়ে তোলেন", নিশ্চিন্ত থাকুন আপনার সন্তানের রেপিস্ট গোকুলে বাড়ছে। হাতে মোমবাতি পোস্টার নিয়ে আর কুম্ভীরাশ্রু বইয়ে তাকে আটকানো যাবে না।


মনের কথা(৪)

মোহর ভট্টাচার্য 

কঠোর কথা শুনতে খারাপ লাগবে। তাও বলি, কারণ বলা দরকার।

প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য যৌন-আবেদন-মূলক যেসব পোষাক হয়, সেগুলো পরিয়ে যখন বাচ্ছাদের টিভি শোয়ে, লাইভে, মঞ্চে নাচতে পাঠানো হয়, তখন মনে পড়ে না কেন কী বার্তা দেওয়া হচ্ছে? কেন তারা ব্যাকলেস চোলি- লেহেঙ্গা পরে যে স্তন গড়েই ওঠেনি তাকে দোলানোর ইমিটেশন করে, কেন তাদের চোখ টিপতে, বিলোল কটাক্ষ করতে শেখানো হয়? কেন হাততালি পড়ে, উল্লাসে দর্শক ফেটে পড়ে যখন "মুন্নি বদনাম হুয়ি" বা "শীলা কেজোয়ানি"র তালে ৪ থেকে ১০ বছুরেদের শেখানো শারীরিক বিভঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়?

কেন সব চেয়ে দাম বেশি চাইল্ড পর্ন আর রেপ পর্নের? দুটো যোগ করুন, দাম আকাশ ছোঁবে। চাইল্ড গোর/ স্নাফ পর্ন হলে তো বিক্রেতা পলকে লক্ষ-ডলার-পতি।

কেন নাম করা অনলাইন শপিং কোম্পানি তাদের বিজ্ঞাপনে বাচ্ছাদের ব্যবহার করে, "অ্যাডাল্ট" সাজিয়ে?

আসলে আমরা বাচ্ছাদের খাই। রোজ। সবাই। নানারকম সুদৃশ্য মোড়কে ঢেকে-রেখে, চকচকে বাক্সে, ঝকঝকে ব্রান্ডিং-এ। নরম তুলতুলে অপাপবিদ্ধ মাংস। আহহ। কেউ কেউ একটু বেশি চিবিয়ে খাচ্ছে, তাই শব্দ হচ্ছে।

এই প্রজন্মের শিশুদের তো আমরা প্রায় কিছুই দিতে পারিনি। জল বাতাস পলিউটেড, আলোয় ইউভি, খাদ্যের অভাব নয়ত ভেজাল, বাসস্থান সংকটে, ক্লান্ত রুগ্ন অসুস্থ পৃথিবী। তিলে তিলে আরো দু'তিন প্রজন্ম ধরে মারার চেয়ে বরং আসুন, খেয়ে ফেলি। খেয়েই ফেলি।

কবিতা 

গল্প

পরিচয় প্রধান

প্রেম কি এমনই হয় ?
কিছু বুঝে ওঠার আগেই
তুমি শুরু করলে মুক্তিকুটির রূপকথা
আত্মময় গল্প শুনতে শুনতে
কখন যে ঘুম এল চোখ জুড়ে
কেউ শঙ্খ প্রলম্বিত বাজিয়ে জানালো এবার রাত্রিকাল শুরু
আমাকে ঘুমিয়ে রেখে
এত সংগোপনে তুমি চলে যেতে পারো ?
এত দ্রুত জ্বালাতে পারো বিম্বিত প্রলয়ের শিখা ?
শুধুই আগুন আজ
ধোঁয়ার কুণ্ডলী অন্তিম পাক খেয়ে ঊর্দ্বগামী
তোমাকেই ছুঁতে চায়
এতই সহজ ! প্রেম কি কখনো ছোঁয়া যায় ?



আমার ঘরভর্ত্তি সাদা পাতায়

অতনু টিকাইৎ

তোমায় নিয়ে কবিতা লিখতে বসলেই
আমি কলম হাতে ভাবতে থাকি।
তোমায় নিয়ে এক পৃথিবী কবিতা লেখার ইচ্ছে আমার
আকাশ দেব, নদী দেব, থাকবে পাখি
কিন্তু কলম আমার থমকে থাকে
আমি ভাবতে থাকি
                    ভাবতে থাকি
                               ভাবতে থাকি।
তোমায় নিয়ে কবিতা লিখতে বসলেই
আমার সাদা পাতা সাদায় থাকে।
আমার খাতাভর্ত্তি সাদা পাতায়
তুমি আছো, কেউ জানেনা
আমার ঘরভর্ত্তি সাদা পাতায়।


আহাম্মক

বিশ্বজিৎ মাইতি

বড়রাস্তা পেরিয়ে আজ বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়,
টিভিতে বলেছে উৎসব চলবে সারারাত।
অগত্যা ফুটপাথ ধরে আমি হেঁটে চলেছি বাঁহাতি-
শহরের এদিকটা বেশ নির্জন,
অনেকটা সেকেলেও বলতে পারেন;
নাকে রুমাল না চেপে হাঁটা যায় না মোটেও,
ভাঙা ল্যাম্পপোস্ট ঘুরে একটা এঁদোগলি
লুনি নদীর মতো হারিয়ে গেছে যেন কোথায়-
তবে সাঙ্কেতিক চিহ্নের মতো জলের কলটি আছে ঢোকার মুখেই,
ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ছে-
বোঝা গেল ওটা এখনো সচল।
আচমকা শুনে যা মনে হয়,
ওটা কোন বিষাক্ত নখ দাঁতওয়ালা কুকুরের চিৎকার হবে-
পায়ে পায়ে এগিয়ে দেখি,
অনেকটা ঠিক বিজনবাবুর নাটকের কায়দায়-
খাবার নিয়ে একটা কালো কুকুরের সাথে
লড়াই করছে একটা রুগ্ন লোক,
আমি চুপিচুপি লোকটার কানেকানে গিয়ে বললাম,
“জিতেছে বাংলা আমাদের রসগোল্লা”
ছন্দ মিলিয়ে আরও কি যেন ভেবেছিলাম,
লোকটা আটকালে আমায় আহাম্মকের মতো,
বললে, “আর ভাত?"

বিনু নামের মেয়েটি

জগন্নাথদেব মণ্ডল

বিনু নামের মেয়েটি অাসলে ডাইনি।ভীষন বিপরীত সঙ্গম পছন্দ করে ও।শক্ত পুরুষমানুষ দেখলেই ছিবড়ে করে দেয়।

ও এখন চাষীমেয়ের মতোন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে অাছে।ওর অাঁচলে বাঁধা অাছে চালভাজা অার ঢ্যাপের খই।নদীতে ফুটে অাছে নীল পদ্ম।ফুলের মৃণালে গোখরো সাপের বাসা।

ওই যে  নাও ভাসিয়ে এগিয়ে অাসছে কালো শরীরের ঘামেভেজা ভুবনমাঝি।ওর বাড়ি বকুলখোলা গ্রামে।
মাঝিকে দেখে গান ধরল চাষীমেয়ে-
" অাঁকড় ধানের হুড়ুম দিমু পানের সাথে গুইয়া
খাওন দাওন শ্যাষ করিয়া ডিঙায় যাইও নাইয়া"

মাঝি নাও ভিড়ালো।ভূতে পাওয়া মানুষের মতো স্পর্শ করলো বিনুর বাড়িয়ে দেওয়া হাত।ছ্যাঁকা লাগল হাতে।এ হাত যেন জ্বরে পাওয়া মানুষের।

নির্জন বাবলাবনের ভিতর সেগুন পাতা বিছানো হল।সাপের মতো মাঝির শরীর বেয়ে উঠে গেল বিনু।শঙ্খলাগা সাপ যেন।শীৎকার ধ্বনিতে বাতাস ভেঙে চুর।ছড়িয়ে পড়ল ঢ্যাপের খই।এতক্ষনে জিওল গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্য অস্ত গেল।

সঙ্গমশেষে ডাইনিমেয়ে অতল ঘুমে ঘুমিয়ে অাছে।বাতাসে বেহায়া কামিনীগাছ ঢেলে দিয়েছে সবটুকু গন্ধ।

শৈশবে তুকতাক জানা বকুলখোলার ভুবন, সন্তানস্নেহে বিনুর ডান স্তন স্পর্শ করল।তারপর চুপিচুপি পালিয়ে এল ভুবনমাঝি।

এরপর থেকে বিনু অার ডাইনিমেয়ে নেই।
এখন ঘামেভেজা কালো পুরুষ দেখলেই বিনুর স্তনযুগল টসটস করে স্তন্যভারে।
বিনুর শরীরে জেগে থাকে মা মা ভাব...

             

একশতম আনন্দের দিন

রুদ্রশংকর

তখন আমার উঠতি বয়স, তখন আমার একশতম আনন্দের দিন।
সর্বক্ষনের সঙ্গী বলতে আলিভাই, তিমিরকান্তি আর দুষ্টু মারুফা
কফি হাউস ছেড়ে মাঝে মধ্যে ডিসুজাও আসত আমাদের আড্ডায়।
এইভাবে দিন যেত, এইভাবে প্রেম পিপাসায় জমে উঠত গল্পঘর,
মাথায় উঠত লক্ষ্মীছাড়া বদনাম।
তবু এক অতল আলোর চোখে আবিষ্কার করি
আমাদের শরীর থেকে শূন্যতায় ফোটে নতুন শষ্যের আভা।
তোমাকে বলছি সভ্যতা, তোমাকে বলছি দেশ
জন্মের সুতোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমাদের কেউ তখন
হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান হতে শেখেনি।
এক নির্ভেজাল ধর্ম-নিরপেক্ষ ছিলাম আমরা
আমাদের রক্তে একই হিমোগ্লোবিন, স্নায়ুতন্ত্রে একই নিউরোন।

তখন আমার উঠতি বয়স, এক মশকীর জন্য কঠিন অসুখ হল মারুফার।
সেদিন ভবিষ্যৎ বাঁচাতে তিন বোতল রক্ত দিয়েছিল তিমিরকান্তি।
বছর ঘুরতে না ঘুরেতেই হেমন্তের হলুদ পাতা যেমন লুটিয়ে পড়ে
তেমনই নির্জীব উত্থানহীন লুটিয়ে পড়ল ডিসুজা,
সমস্ত রোমশ ভয় শুঁড় দিয়ে টেনে সেসময় রক্ত দিয়েছিল আলিভাই।
শুধুমাত্র এক জাতি হয়ে বেঁচে থাকার জন্য
শুধুমাত্র মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার জন্য
হিন্দুর রক্ত, মুসলমানের রক্ত, খ্রিষ্টানের রক্ত মিশে গেল শরীরে।

তোমাকে বলছি দেশ, জীবনের উল্টে যাওয়া বয়সগুলোয়
আমাদের খাবারের কোন নিষেধ ছিল না,
তোমাকে বলছি সভ্যতা, আমাদের নিষেধ ছিল না পানীয়র;
প্রকৃতির মহান বিবর্তন আমাদের সর্বভুক করেছিল।
তাতে আমাদের ক্ষতি হয়নি কিছু, সমাজেরও ক্ষতি হয়নি একবিন্দু
তখন আমার উঠতি বয়স, তখন আমার একশতম আনন্দের দিন।

গল্প থেকে ঈশ্বর

পিনাকী দত্ত গুপ্ত

অনেক বার কাটাছেড়া করার পরও গল্পটা দাঁড়ালো না।
একটা আদিম রিপুর তাড়নায় ছুটে চলছি এঘর থেকে
ওঘর। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে কপালে।
অথচ জানি, দুর্গা প্রতি রাতে কড়া নাড়ে আমার দরজায়।

আমার বাড়ির কাজের মেয়েটার নামও দুগ্গা।
একদিন ওকে ডেকে বললাম, তোর বাপের নাম কিরে ?
ও চুপ করে রইলো। ভাবলাম নিচু জাতের মেয়ে।
বললাম, তোর বিয়ে হয়েছে? ও মাথা নেড়ে বলল – না।
যদিও মাথায় সিঁদুর, হাতে শাঁখা।

এখন গভীর রাত। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে নেমে আসছে
আকাশের তারা। দূরন্ত ঝড় নিয়ে আমি বসে আছি।
হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দে দরজা খুলে দিতেই দেখি
দাঁড়িয়ে আছে কাজের মেয়ে ‘দুগ্গা’। শতচ্ছিন্ন কাপড়ে
শরীরটা ঢেকে ও বলে উঠল, ‘বাবু, আমায় থাকতে দিবি?

একটা আদিম রিপুর টানে আমি আজ ‘ঈশ্বর’ হয়ে গেছি।
এখন আমার দুই ছেলে। নাম রেখেছি ‘অপু’ আর ‘অমল’।
ওদের মায়ের নাম  ‘দুগ্গা’ নয় ...'দুর্গা' ।।

আজো কাঁদছে গান্ধারী

মতিউল ইসলাম

যুদ্ধের জয়োদ্ধত সৈনিকের হুঙ্কার  নাকি
পরাজিত পুত্রহারা মায়ের অভিশাপ?
ক্ষমতার পাহাড়চূড়া,না শোকাতুর
মায়ের বিলাপ?
সাক্ষী মহাভারত,
ভুলে গেছ মুষল পর্ব?
ভুলে গেছ শাম্বর লোহা প্রসব,
সেই লোহা দিয়েই তৈরি জিরুর তির,
যে লোহার অণু পরমাণু তে
তোমাদের দুর্বিষহ অহংকার,
ঠিক যেন তোমাদের ক্ষমতার
অপব্যবহার.
নৈরাজ্যের সমুদ্র স্রোতে
তখন ডুবছে যাদব কূল,
ঠিক তখনই ঝলসে উঠলো
জিরুর তির,
বিদ্ধ হলো শ্রীকৃষ্ণ,
কুরুক্ষেত্রের চালক
যার মুখ গহ্বরে খেলা করে
বিশ্ব ব্রম্ভান্ড.
এর পরেও বলবে অবলা রমণী গান্ধারী?
হাজার গান্ধারী কাঁদছে,
শুধু মনে রেখ
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে বারংবার।

তুমি ও নক্ষত্রের দিন

প্রত্যূষ কান্তি কর্মকার

আমি দাঁড়িয়ে আছি বিকেল থেকে আমাদের খেলার মাঠে
কখন সন্ধ্যে আসবে,শীতের ঝলসানো রূপো রঙের সন্ধ্যে
আর আসবে তোমাকে ছুঁয়ে আসা পরিব্রাজক কুয়াশা
তার সাদা চাদরের কোঁচড়ে মুড়ে দেব আমার যা কিছু
সন্ধ্যের এক থালা চাঁদ,কাছ দিয়ে উড়ে যাওয়া পাখিদের ডানা ভরা সোনা রঙ আলো
কার্নিশে ঝুলে থাকা মেঘভাঙা স্বপ্নের ভ্রূণ
আর এসব নিয়ে যাবে ভেসে ভেসে পৌঁছে যাবে তোমার কাছে-
এগুলো সবই গল্পকথা,এরকম হয়না আসলে কখনও
ঘাসের ভেতর দিয়ে গুঁড়ি মারা পোকারাও জানে এসব আসলে ছেলেভোলানো কথা
গত বছর বসন্ত আসবার আগেই আমাদের চুম্বন আসবার কথা ছিল
তোমার বুকের মাঝখানে আমি প্রাসাদ দেখেছিলাম,বসন্তের সন্ধ্যা, কুয়াশার ভোর আর
তোমার আমার প্রেমের সৌধে সশ্রদ্ধ প্রণামে সাজানো প্রাসাদ অলিন্দ
তুমি আসোনি বলে ঠোঁটের বাসা ছেড়ে চুম্বন উড়তে পারেনি সেই দিন,অন্ধ পাখির দেওয়ালে ধাক্কা খাওয়ার মত আমার বাড়ানো হাতের সঙ্গম পিপাসা আছড়ে পড়েছে
তোমার গভীরতর স্বপ্নের চৌকাঠে
তাই সিদ্ধান্তে আসি তুমি আমার জন্য নও
তোমার কাছে আমি নগণ্য হলেও আমার নিজস্ব নক্ষত্রের দিন এখনও বাকি আছে।

কী আর বলব তোমাকে

শ্যামশ্রী রায় কর্মকার

কী আর বলব তোমাকে!
সমস্ত পুরনো বই জমা পড়ে গেছে
সিলেবাস  শেষ
চশমা হাতে দাওয়ায় দাঁড়িয়েছি
হাওয়ায় তুষ উড়ছে
পাশাপাশি উড়ে যাচ্ছে নীতিবাক্য,সমাস, প্রত্যয়
কানে হেডফোন গুঁজে বাইকে সওয়ার হয়ে উড়ে যাচ্ছে স্কুলের প্রাক্তনী
আমি কিছু শেখাতে পারছি না
গোঁফ মুচড়ে মুচকি হাসছেন রবীন্দ্রনাথ, টলস্টয়,ও হেনরি
আমার শেখানো শব্দ গুটখার ছেঁড়া  প্যাকেটের সাথে
আকুলিবিকুলি গড়িয়ে যাচ্ছে সকাল থেকে সন্ধ্যে,
মাস থেকে বছর,বছর থেকে যুগসন্ধিকাল,
আমার হাতের তালুর ফাঁকে গলে যাচ্ছে সরস্বতীর হাঁস
কী যে করি আমি!
কিছুতেই ধরে রাখতে পারছিনা
আমি প্রাণপণ চীৎকার করছি
বাক্যের আগে শব্দ,শব্দের আগে বর্ণ,বর্ণের আগে মূল্যবোধ
আমার সমস্ত চীৎকার ঝাঁপ দিচ্ছে ইশকুলের ক্লাসঘরে
সাইকেলের গ্যারাজে,  মাঠেঘাটে, ট্রামে বাসে ট্রেনের দরজায়
আমার হাত থেকে ফস্কে পড়ে যাচ্ছে চক ডাস্টার ছাত্রের মনোযোগ
ধড়াম করে আছাড় খাচ্ছে শ্রদ্ধাভক্তি
হোঁচট খেয়ে ভাবতে বসছি ভুলটা কোথায়
সাতসকালে খবর দেখে চমকে উঠছি
মাঝের পাতায় মায়ের মত মেয়ের মত মানুষগুলো
উপড়ে যাচ্ছে থেঁতলে যাচ্ছে
বাবার মত ভাইয়ের মত ছেলের মত মানুষগুলো
পিছলে যাচ্ছে লোভের ফাঁসে লটকে যাচ্ছে
কী যে করি ভাবতে ভাবতে
তলিয়ে যাচ্ছি, হাঁচড়পাঁচড় বাঁচতে চেয়ে ঘনিয়ে উঠছি
অবিশ্বাস্য গড়িয়ে যাচ্ছি সব মানুষের চোখের কোণায়









Friday 1 December 2017

সাহিত্য এখন, ডিসেম্বর, প্রথম পক্ষ, বিশেষ আকর্ষণ অনুবাদ সাহিত্য




সম্পাদকীয়
 সাহিত্য এখনের তৃতীয় সংখ্যায় এসে আলাদা কিছু করার কথা মনে হল। একথা আমরা সকলেই জানি যে 'সত্য মাত্রেই সাহিত্য নয়'। হৃদয়ের প্রকৃত অনুভূতি যখন নানান আভরণে ভূষিত হয়ে আমাদের সামনে আবির্ভূত হয়, তাকেই আমরা সাহিত্য বলি। তবু মূল কথাটি হল আমাদের উপলব্ধির কথা। তাই গল্পের বদলে এই সংখ্যায় এমন কিছু উপলব্ধি হাজির করলাম, যা আজকের দিনে অনুভব করা বড় প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
সেই সঙ্গে নিয়ে এলাম এমন কিছু কবিতার ঝাঁপি,যেগুলি সমাজ ও সাহিত্যের নিরিখে বিশ্ব সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে ফেলেছে ইতিমধ্যেই।আমাদের কবি বন্ধুরা প্রত্যেকেই অত্যন্ত নিষ্ঠা এবং পরিশ্রমের সঙ্গে এই কাজটি সম্পন্ন করেছেন। আশা রাখি, আপনাদের সংখ্যাটি ভাল লাগবে। পড়ুন, আলোচনা ও সমালোচনা করুন, বন্ধুদের কাজকে বেশি করে ছড়িয়ে দিন নতুন নতুন পাঠকের কাছে... এটুকুই অনুরোধ। ভাল থাকবেন।



মনের কথা (১)
বেড়ালের তালব্য শ

অনেকদিন ধরে লিখব ভাবছি। হয়ে উঠছে না। এমনিতে হাসতে ভালোবাসি, অন্যকে হাসাতে পারলে আরো ভালো লাগে। কিন্তু মাঝে মাঝে জংলা রাগ হয়। ঘৃণা। 

আমি খুব প্রোটেক্টেড জীবন যাপন করেছি গড়ে ওঠার সময়টা। ঊর্ধ্বতন চৌদ্দপুরুষে শিক্ষার সংস্পর্শ থেকে আসা উদারমনস্ক কিন্তু ঐতিহ্যবাদী বাবা-মা খারাপ দেখতে, শুনতে, বুঝতে দেন নি। ভুল করেছেন, কিন্তু তা নিয়ে এখন বিচার করতে বসে লাভ নেই। 
খারাপ তো স্কুল কলেজেও দেখিনি। আশেপাশে যেসব ছেলেরা পড়াশোনা খেলাধুলো করত তারা বিচ্ছু বদমাইশ পাজি ন্যাকা আহ্লাদী বা গোঁয়ার ছিল, খারাপ ছিল না; অথবা, খারাপ বলে বুঝতে পারিনি। 

তাই প্রথম যখন খারাপ দেখলাম, চিনতে পারিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় মানে প্রথমে রেডিফ ক্যালকাটা গ্রুপ, পরে অরকুট, তারও পরে ফেসবুক। একটু দেরীতে ঢুকেছিলাম তাই এএসএল দিয়ে আলাপ শুরু হয় কেন বা কারা সেটা করে বুঝতে সময় লাগলো। তারপর যেটা প্রত্যক্ষ করলাম তা হলো একটা সর্বগ্রাসী ক্ষুধা। মেয়ে বলে বুঝতে পারলেই হটচ্যাটের আহ্বান, খিস্তি, প্রেম-প্রেম ভাব এবং হটচ্যাটের আহ্বান, প্রেম-প্রেম ভাব, খিস্তি। যে গ্রুপেই যাই ঐ এক এএসএল। কেউ কথা বলে না, আলোচনা করে না, কারো কোনো প্রশ্ন নেই, শুধু দু'লাইন পর থেকে টেল মী ইয়োর ফ্যান্টাসিজ অ্যান্ড ডার্কেস্ট সিক্রেটস। কেন হে বাপু, তুমি বা তোমরা কে? তোমরা কি আমার কলেজের বন্ধুরা, ছদ্মনামে বুভুক্ষু প্রেতের মতো ঘুরছ? তোমরাই কি আমার সঙ্গে বসে ছবি আঁকা শিখতে? গান গাইতে? তোমাদের সঙ্গেই কি ক'বছর আগে পর্যন্ত ক্রিকেট বা ক্যারম খেলেছি? তখনো কি এটাই ভাবতে যে এই নারীমাংসটার ডিপেস্ট ডার্কেস্ট সেক্স-সিক্রেট কী? 

যে পুরুষ যতো নিজের স্ত্রীকন্যাবোনের প্রতি রক্ষণশীল, সে দেখি ততো অন্য মেয়ের প্রতি হিংস্র, আক্রমণাত্মক। সন্দেহ জাগে, রক্ষণশীলতার উৎস কি তাহলে দ্বিবিধ; আমার সম্পত্তি/ আমার সম্পত্তি নয় এই মেরুকরণ, এবং অপরাপর পুরুষ সম্পর্কে স্বজাত্যবোধ-জাত প্রকৃষ্ট ধারণা, যে রাস্তাঘাটে যারা হাঁটাচলা করছে, বাসে ট্রামে উঠছে তারা ঠিক এই আমারই মতো নারীমাংসলোলুপ? 

এর উত্তর নেই। ইতিহাস বরাবরই his story. মেয়েদের হাতে কলম উঠেছে সে আর কতো বছর? এখনো আমাদের উচ্চারণ নেই, বয়ান নেই, নেই প্রকাশক্ষমতা। এখনো আমরা কীই বা পারি, খুব সাধারণ কিছু নিজস্ব, ব্যক্তিগত প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, বিদ্রোহ করা ছাড়া? সেইসব বিদ্রোহের সীমারেখা, অস্ত্রশস্ত্রও আবার নির্ধারণ করে দেয় পিতৃতন্ত্র। কোথায়, কবে, কতোটুকু, কোন রঙের কী পোষাকে কাদের মিছিলে হাঁটবো আমরা, মুখের ভাষা কতোটা "ভদ্রজনোচিত" বা "সাব-অল্টার্ন" হবে; কতোটা সাধারণের বোধগম্য হবে বা কতোটা থাকবে জার্গনের হেঁয়ালির অন্ধকারে। আমরা পড়াশোনা করব কি না, চাকরি করব কি না, কটা বাচ্ছা হবে এবং কবে-কখন হবে, হলে সেই সন্তানদের লিঙ্গ কী হবে, বাচ্ছা জন্মানোর পর আমরা আর চাকরি করব নাকি ফুল টাইম "মা" তথা "গৃহবধূ" হয়ে যাবো, এসবই এখনো ৯৯% ক্ষেত্রে পিতৃতন্ত্রই ঠিক করে দেয়। যেমন ঠিক করে দেয়, অবিবাহিতা, বিধবা, স্বামী-পরিত্যক্তা, ডিভোর্সি মেয়েদের সামাজিক অবস্থান। ধর্ষিতার সংজ্ঞা, ধর্ষণের কারণ। ধর্ষণ, যৌন অত্যাচারের সমূহ সম্ভাবনার সামনে পড়ে অথবা পরবর্তী সময়ে অত্যাচারিতা নারীটি কী ভাববে, কী করবে, তাও সম্পূর্ণভাবে ঠিক করে দেয় সেই পিতৃতন্ত্রই। কারণ, আর কোনোভাবে বাঁচতে তো আমরা শিখিনি! 

আর তাই, ইয়াজিদি মেয়েরা "আমাদের যৌনদাসী ক্যাম্পের ওপর বোমা ফেলে সবাইকে মেরে ফেলো" বলে আবেদন জানালে আমরা তা মিথ্যে বলে নাকচ করে দিই, বা জীবনের চূড়ান্ত দিক-পরিবর্তনের সম্ভাবনার কথা শোনাই; উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বাণী পাঠাই। তাই ২-৪ লক্ষ বাঙালি নারী বারংবার গণধর্ষিত হবার পর তাদের দেশ, সমাজ তাদের কথা সম্পূর্ণ চেপে যায়, তাদের সরকার একবার "বীরাঙ্গনা" উপাধি দিয়ে আর টুঁ শব্দটিও করে না তাদের সম্বন্ধে; তাদের ধর্ষণজাত হাজার কুড়ি "যুদ্ধশিশু" (সরকারি হিসেবে) চ্যারিটির হাত ধরে পৌঁছে যায় ইউরোপ আমেরিকায়; এমনকী তাদের নিয়ে স্বাধীন গবেষকদের লেখাপত্তরকে অগ্রাহ্য এবং ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া হয় মাত্র চল্লিশ বছরের অন্তরালেই। তাই, মা মেয়েকে নিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়লে সবাই প্রশ্ন করে, জিয়ারপি ডাকেনি কেন, আগের স্টেশনে নেমে যায়নি, যদি মরে যেতো তো মেয়ের মৃত্যুর জন্য দায়ী হতো কে, মা ছাড়া? তাই চার বছরের শিশুকন্যা যৌনাঙ্গে ক্ষত নিয়ে কাঁদলে তার মা যখন স্কুলের বিরুদ্ধে, নিগ্রহকারী পুংশিশুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় তখন দেশ ভেঙে পড়ে ছিছিক্কারে, পুত্রসন্তানের বাবামায়েরা বলেন ছোট্ট মেয়েটি মিথ্যে বলছে, তাকে হয়ত তার বাড়িতেই কেউ অত্যাচার করেছে, তার বাবা-মা প্রচারের আলোয় আসতে চাইছেন, মা "নারীবাদী" তাই "নির্দোষ" পুং-শিশুটির প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন। তাই চাকরি করতে না চাওয়া মেয়েটি আত্মহত্যা করলে আমরা চোখ কপালে তুলে বলি, সে কী! আত্মনির্ভর হওয়া তো সবচেয়ে সুখ ও স্বস্তিদায়ক! এবং ভুলে যাই যে সেই মেয়েটি হয়ত "বাপের বাড়িতে" কোনোদিন জানেইনি, তাকে ভাবতেই দেওয়া হয়নি যে তারও চাকরি করা উচিত, নিজের পায়ে দাঁড়ানো উচিত এবং বিশেষজ্ঞরা তাকে, তাদেরকে "দুর্বল মানসিকতার" বলে দেগে দেন। তাই সু-কাই অহিংস বৌদ্ধদের দ্বারা রোহিঙ্গা মেয়েদের নির্যাতনের প্রসঙ্গে মুখে কুলুপ দেন, আর পৃথিবীর তাবৎ প্রগতিশীলরা সেই রোহিঙ্গাদের দ্বারাই উত্তরপূর্ব বাংলাদেশ এবং ভারতীয় মেয়েদের ওপর চালানো অত্যাচার নিয়ে ততোটাই চুপ করে থাকেন। তাই প্রবাসী "নারীবাদী" বৌদিদি রায় দিয়ে দেন, রাজস্থানী মেয়েরা সবাই স্বামীর ঘরে বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার; তাই বিধর্মী যবনসেনা তুলে নিয়ে গিয়ে গনিমতের মাল হিসেবে গণধর্ষণ করলে, দাসীহাটে বেচে দিলে কীই বা এমন যেতো-আসতো, out of the frying pan into the fire হতো না কী? 

এখনো পর্যন্ত প্রাপ্ত প্রমাণ থেকে ভৌগোলিক সময়-সারণি অনুযায়ী মানুষ অভিধা দেওয়া যায় এমন প্রাণীর আবির্ভাব মাত্র দু'লাখ বছর আগে। পৃথিবীর বয়েসের (প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর) কাছে এই সময় হলো নস্যি। সময়ের চিরকালীন ছন্দ, বৃহত্তর ছকে তাই হয়ত মানুষীদের এইসব ছোটখাটো দুঃখদুর্দশা, সমুদ্রবক্ষে বুদ্বুদের মতো ক্ষণিক, তুচ্ছ, অর্থহীন। হয়ত এভাবেই লিঙ্গসাম্য আসবে, নারীমুক্তি ঘটবে, অতি ধীরে, অতি মন্থরতায়। ততোদিন এইসব খেলা চলুক। আমরা পিতৃতন্ত্রের শেখানো বুলি দিয়ে, চোখে সেই একই রেফারেন্স ফ্রেমের ঠুলি এঁটে, আলোচনা এবং ক্রিটিক করতে থাকি সেই একই চিন্তাপদ্ধতি থেকে উদ্ভূত শিল্পের, সাহিত্যের, ভাবপ্রকাশের সমস্ত ভঙ্গীমার, যেখানে নাকি "মেয়েদের কথা" বলা হয়েছে। আমাদের সব মেয়েদের সবটুকু বাঁচা এইভাবেই প্রাকনির্ধারিত হতে থাকুক। মরাও, মরাটুকুও। জীবনের ওপর যাদের অধিকার নেই তারা নিজের মতে, স্বেচ্ছায় মরতে পারবে, এ আবার কেমন কথা? তারা মরবে, শান্ত হয়ে, চুপ করে, চুপিচুপি। কম খেয়ে, অপুষ্টিতে, অত্যধিক সন্তান-ধারণ করে, চাকরি এবং সংসারের জাঁতাকলে পিষে,  পুরুষের ঘটানো যুদ্ধে বোমার আঘাতে, দুর্ভিক্ষের সময় তাদের খাদ্য হয়ে, গায়ে বোমা বেঁধে, তাদের যৌনদাসীত্ব স্বীকার করে। এর কোনোটা না হতে চেয়ে মরে গেলেই, মরে নিষ্কৃতি পেতে চাইলেও, সমস্ত রকম ধর্ম, যাদের সব কটাই প্রায় পুরুষ-রচিত, পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত, ছুটে আসবে আত্মহননকারীকে হয় ধিক্কার দিতে। অথবা লোকাচার তাকে বানাবে দেবী, আত্মত্যাগে মহিমান্বিতা। 


তবু, সময়ের এই তাৎক্ষণিকতায় দাঁড়িয়ে মনে হয়, উপকথার রাণী পদ্মিনী ষোল হাজার রাজপুত মেয়েকে নিয়ে জওহরব্রত করে ভুল করেছিলেন কি না তা বাংলাদেশের "বীরাঙ্গনা"দের দিকে তাকালেও হয়ত কিছুটা বোঝা যায়। সেই তারা, যাদের খবর তাদের পরিবার, সমাজ, দেশ, কাল কেউই রাখেনি, রাখতে চায়নি। সেই তারা, রেপ ক্যাম্পে যাদের ব্যবহার করা হয়েছিল একটা জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে দেবার জন্য। শত্রুপক্ষের জেনারাল টিক্কা খান যাদের গর্ভবতী করে রেখে যেতে নিজের সৈন্যবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যাতে পরের প্রজন্ম হয় "পিতৃভূমি"র প্রতি উদ্বেল। আজকের বাংলাদেশে পাকিস্তান-প্রীতি দেখলে আমার সত্যিই মনে হয়, পদ্মাবতীর পিতৃতন্ত্র কতোটা ভুল জানি না, তবে তার জায়গায় থাকলে আমিও পুড়ে মরতেই চাইতাম, মেয়ের হাত ধরে ঝাঁপ দিতাম চলন্ত ট্রেন থেকে, ইয়াজিদি ভাইঝির মুখে মাখিয়ে দিতাম ব্যাটারি অ্যাসিড। মেরে মরতে না পারলে অন্ততঃ দিনের পর দিন relentless অত্যাচারের সামনে নিরুপায় হয়ে পড়ে না থেকে মরে যাবার চেষ্টা করতাম, কারণ সেই মৃত্যুও একরকম মুক্তিই। এই সিস্টেমে জীবনটা আমার নয় যখন, মৃত্যুটা ক্ষমতায় কুলোলে অন্ততঃ নিজের করে নিতাম, নিতামই।



 মনের কথা(২)
দেবশ্রী  মিত্র

সম্প্রতি অন্তত দুটি ঘটনায় দু'জন নববিবাহিতা মহিলা আত্মহত্যা করেছেন কারণ শ্বশুরবাড়ি থেকে চাপ দেওয়া হচ্ছিলো চাকরি করার জন্য। রিলেটেড অন্যান্য কারণও থাকতে পারে, কেস শেষ না হওয়া অবধি কিছুই বলা যায় না। তবে, আমি শুধু মা হিসেবে দু'চারটে কনসার্ন রেখে যাই। আমরা সন্তানদের ঠিকমতো মানুষ করছি তো? কোথাও কোন বড় ভুল হয়ে যাচ্ছে না তো? আরও মেয়েকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়, এমন ভবিষ্যৎ তৈরি করে যাচ্ছি না তো? 

ছেলে সন্তান আর মেয়ে সন্তানের মধ্যে "আপব্রিংগিং" এ তফাত করাটা একটা সুপরিচিত নিয়ম আমাদের সমাজে। যে বাড়ি মেয়েকে স্বাবলম্বী বানায়, তারাও দুধের গ্লাস আর মাছের বড় টুকরো ছেলেকে দেয়। কথায় কথায়, মেয়ে যখন বাড়ির কাজটাও সাথে শিখুক, বলে। "আমার মেয়ে রাঁধতেও পারে" বলে প্রতিবেশীর কাছে গর্ব করে, ছেলের জন্য কিন্তু করে না। এই যে তফাতটা, অতি সূক্ষ্ম তফাতটা, এটাই কিন্তু একটা মেয়ের "ছেলে আর মেয়ে আলাদা" এই মানসিকতা গড়ে দেয়। বিয়ের পরেও তারই প্রতিফলন ঘটে। স্বামী খানিক হুকুম করতে পারে, আয়েশ করতে পারে, অন্যায় জুলুমও করতে পারে। কারণ সে পুরুষমানুষ। এই মানসিকতা তো আমরাই তৈরী করে পাঠাই মেয়ের মধ্যে। 

দুই, স্বাবলম্বী হওয়া। অর্থনৈতিক এবং মানসিক, দুভাবেই। বেঁচে থাকতে গেলে টাকা লাগে এবং সেটা রোজগার করতে হয়, এটা একটা কঠিন সত্য। প্রত্যেক সুস্থ মানুষের উচিত একটা বয়সের পর নিজের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়া। চাকরি করার জন্য কেউ চাপ দিক বা না দিক। শ্বশুরবাড়ি অবধি যাওয়ার কী দরকার, মেয়েকে এই সহজ সত্যি কথাটা কেন শেখাবো না? যে মেয়ে চাকরি করে না, ঘরে শ্রম দেয়, তাকে কোনরকম ছোট না করেও বলা যায়, কেন সে একা শুধু ঘরে শ্রম দেবে এবং বাইরে যাবে না? কেন? ঘর এবং বাইরে, বিয়েতে দুজায়গাতেই দুজনের সমান দায়িত্ব, যদি না কোন শারীরিক অসুস্থতা থাকে। আমি নিজেই যদি নিজের আর্থিক দায়িত্ব নিতে না চাই, অন্য কেউ কেন নিতে বাধ্য থাকবে? প্রচুর মেয়ে সন্তান জন্মের পর চাকরি ছেড়ে দেয়, এই বলে যে সন্তান কে দেখবে? হাজার হাজার লাখ লাখ মহিলা সন্তানকে ডেকেয়ারে রেখে চাকরি করেন। তাদের সন্তানরা সবাই অমানুষ হচ্ছে কি? স্বাবলম্বী হওয়াটা বেসিক প্রয়োজনীয়তার মধ্যে গণ্য হওয়া উচিত। ও লাজুক, এ কথা কম বলে, এসব কোন যুক্তি না। যে লাজুক তাকে কেউ ফ্রন্ট ডেস্কে কাজ করতে বলে নি। পৃথিবীতে আরও হাজারটা কাজ আছে করার। 

তিন, যদিও দ্বিতীয়টা করলে এইটা করতে লাগবে বলে আমার মনে হয় না, তবুও বাবা মা দয়া করে বিয়ের আগে মেয়েকে একটু বলবেন কি যে বাবার বাড়িতেও তার একটু কদিনের জন্য জায়গা হবে, খুব অসুবিধা হলে, যতই তার বিয়ে হয়ে যাক না কেন? বলবেন কি যে পাশের বাড়ির কাকিমার তির্যক দৃষ্টির চেয়ে মেয়ে তাঁর কাছে দামী? মেয়ে যাবে কোথায়? এই প্রশ্ন শুনে শুনে কানে ব্যথা হয়ে গেছে। আর শুনতে ইচ্ছা করে না। অত্যাচারিত মেয়েকে দু'দিন আশ্রয় দিলে যাদের মান যায়, তারা মেয়ে সন্তান জন্মালে মেরে ফেলেন না কেন আমি বুঝি না! বাঁচিয়ে রেখে কী হবে যদি এই পরিণতির দিকেই ঠেলে দিতে হয়? 


বাবা মায়েরাও একটু মানুষ হোন দয়া করে। খালি খুনীকে দোষ দিয়ে লাভ কী, যদি আপনি একজন ভালনারেবেল, আত্মসম্মানহীন, নিজেকে রক্ষা করতে অসমর্থ, ভীতু পোটেনশিয়াল ভিক্টিম তৈরী করে তাকে খুনীর কাছে পাঠান? আপনি তো জেনেশুনেই মেয়েকে মরতে পাঠিয়েছেন, অভিযোগের চারটে আঙুল তো আসলে আপনারই দিকে।



জেলখানার থেকে
কবিতা: সামি আল-কাশিম (প্যালেস্টাইন)

অনুবাদ:চন্দ্রশেখর ভট্টাচার্য
.
বন্ধু আমার
ওরা আমার দরজায় কড়া নাড়লে
তুমি নাছোড় কান্নায় ভেঙে পড়ো।
কখনও ফুঁপিয়ে, গুমরে কখনও,
কখনও বুকফাটা বিলাপী চিতকারে।
.
মা আমার, মাগো,
শুধু তোমার চোখের জল
বুকচাপা পাথরের বেদনা দেয়।
.
মা, জানো এই গরাদের আড়ালেই
আমি অনুভব করছি বোধের আশ্চর্য
অনুপম চেতনা আর
প্রগাঢ় অভিজ্ঞতা উপলব্ধি করছি।
.
আমি ঠিক জানি,
আমার শেষ দর্শণপ্রার্থী হয়ে আসবে
কোনও লোহার ঠোট আর লম্বা ডানার
কোনও কুতসিত অন্ধ বাদুড় নয়!
আসবে আমার স্বাধীনতা,
আমার আজন্মলালিত স্বপ্ন!
.
মা আমার, তুমি দেখো,
আমার বিশ্বাস, সেই উজ্জ্বল দিন
আসবেই, আসবেই, আসবেই...


ওয়েস্ট রাইডিং (পশ্চিমের পথে সওয়ারী )
ইয়ান এম্বারসন
অনুবাদ:গোপেশ দে

আঁধারের রাস্তায় উজ্জ্বল শাড়ি
ইয়র্কশায়ারের আকাশে ধূসরতা
ধ্বংসপ্রাপ্ত কারখানার জন্য স্তব
কারলেওয়ার কান্না খোঁজ নিচ্ছে বারংবার।

কোনদিন জেন এই মইয়ে বসে বসে
চাঁদটাকে খড়ে ডুবে যেতে দেখেছিল
একটা কুকুরও ছিল,আর একটা ঘোড়া
ধাতব শব্দে হেঁটে পার হয়েছিল এ ধূসর রাত


এরপরে শুধু তুমি অপেক্ষায় রত
(কুকুরেরা  বন্ধুকে স্বাগত জানাতে দৌড়ে আসেনা)
রক্তাভ সূর্য পড়ন্ত বিকেলে ডুবে যায়
হতাশার লাল ডিসেম্বরে।

এবং পৃথিবীরা এখনও  আঙুলে ভর করে তাদের তারাদের প্রদক্ষিণ করে
যখন মঞ্চে তরুণ অভিনেতারা দেখা সাক্ষাৎ করে
সোনালী ফ্রেমে এক অষ্পষ্ট ছবি
উজ্জ্বল শাড়ি আঁধারের রাস্তায়।



সিজফায়ার(যুদ্ধবিরতি)
মাইকেল ল্যাংলি
অনুবাদঃ সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়


বাবার কথা মনে করে
অ্যাকিলিস কান্নায় ভেঙে পড়ল
হাত ধরে আস্তে করে এগিয়ে নিয়ে গেল বৃদ্ধ রাজাকে।

প্রায়াম তারই পায়ে কান্নায় লুটিয়ে পড়ল
বিষন্ন বাতাসে প্রাসাদ না ভরে যাওয়া পর্যন্ত
চোখের জলে ভিজে গেল দুজনেই।

হেক্টরের নিষ্প্রাণ দেহটা হাতে নিয়ে
বৃদ্ধ রাজার কাছে উপস্থিত হল
যেন সব ধুয়ে মুছে গেছে।
যুদ্ধসাজে সাজিয়ে প্রায়ামের হাতে তুলে দিল
যেন ট্রয়ের যুদ্ধবিরতির দিনে
বাড়িতে এক উপহার নিয়ে চলেছে।

তারা যখন একসাথে খেতে বসেছিল
প্রেমিকের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল পরস্পরের দিকে
অ্যাকিলিসের শরীরটা ছিল দেবতার মত
প্রায়ামকেও সুন্দর মানিয়েছিল
পারস্পরিক কথাবার্তার মাঝপথেই
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলেছিলঃ

“আমি নতজানু হই। আমি তাই করি
যা আমার করা উচিত।
আমি অ্যাকিলিসের হাতে চুমু খাই
সেই তো আমার সন্তানের খুনী”।  




সেন্ট্রিফিউজ(কেন্দ্রাতিগ)
ডিন ইয়ং
অনুবাদঃ পিনাকী দত্তগুপ্ত


সম্ভবত সেটি ছিলো মধ্যরাত যখন ম্যাপেল গাছটার নিচে
শেষবার আমরা কথা বলেছিলাম, যেখান থেকে কবিতাটির
জন্ম হল। তোমার শরীরের দুর্বার চুম্বকীয় আকর্ষণ, সোঁদা
গন্ধ, উড়ন্ত উত্তরীয় , কিংবা এক দীর্ঘ চুম্বন উপেক্ষা করেও
কোনো এক অনতিক্রম্য টানে আমার কবিতা উড়ে যাচ্ছে
মহাজাগতিক দুর্গম উচ্চতা ভেদ করে। আর সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে
চূড়ান্ত উৎকন্ঠায় চেয়ে আছে দুর্বৃত্ত ছায়াপথ।  এসো, রক্ষা
করো, যাতে ঐ কৃষ্ণগহ্বর থেকে আমরা বিচ্ছেদের অতল
গভীরে তলিয়ে না যাই। শীতের লাল আপেলের মিষ্টি গন্ধ
আর দুর্বিনীত ছাই এর মন্দবাসের তীব্র যুগপৎ আকর্ষণে,
আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি একা, আজও ম্যাপেল গাছটার নিচে। 


মহান ধর্মযাজক বসে আছেন উচ্চ আসনে। আর যিনি তার
পদতলে, তিনিও মহান ধর্মযাজক। পাখিদের বহিরঙ্গে নরম
পালক, অস্থির গভীরে বুদবুদ। সম্মুখে আঁধি ও বৃষ্টি, তবুও
মেটাতে হবে ঋণ। উল্কার মতো ঝ’রে পড়া ধন ভান্ডারে মৃত্যু
নিশ্চিৎ জেনেও তুমি যেন প্রবেশ করে চলেছ এক অপার্থিব
আকর্ষণে। আর মনে পড়ছে সেই অনুবাদকের কথা যে বিষন্ন
ক্লান্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে একটি ব্রাজিলিয়ান কবিতার
বইএর  পিছনের মলাটে,, যেন এক অশ্বেতরের পিছনে ছুটতে
ছুটতে নিজের অজান্তেই সে প্রবেশ করেছে একবিংশ শতকের
অনভিপ্রেত সন্ধিক্ষণে। ছুটতে ছুটতে হঠাৎই পিট্সবার্গের বিবর্ণ
পথে পশমের জ্যাকেটের নিচে তাঁর নিঃশ্বাস হালকা হয়ে আসছে।
মনে করো,  ধুলোয় ঢাকা রাজপথ, একটু উত্তাপের আশায়  জড়ো
করেছে অবিন্যস্ত আণবিক হাসি। তারপর, বিস্মৃত প্রেমিকার কথা
ভেবে, দাগলাগা জীর্ণ পাতলুন পরিপাটি করে জড়িয়ে নিয়েছে তার
অমলিন দেহে।

আমরা হয়ত এভাবেই অরণ্যের সুগভীরে কোণে হেঁটে চলছিলাম
আগামীকে অতিক্রম করে আরো কিছু বেশি পান করার মায়াবী
নেশায়। দুহাত নাড়িয়ে, ভেঙচি কেটে,  সেই আগামী নিশ্চিৎ
করছিল আমাদের বিচ্ছেদ। যদিও আমি নিঃশব্দে তোমায় অপহরণ
করতে চেয়েছিলাম। তবু জেনো আমি উৎকণ্ঠিত নই। অবশেষে,
আমার বিষাক্ত নখ ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে আমারই হৃৎপিন্ডের 
 নরম চাদরে। আমি আবিষ্কার করতে চাই স্বেচ্ছামৃত্যুর সুখ। আমি
যেন অবিন্যস্ত হয়ে যাই যখন সে আলোর কথা বলে রাত্রির কাছে, 
যখন অজাতশত্রু মেঘ তার ভয়ঙ্কর ছায়ার আড়ালে গল্প করে চাঁদের
সাথে,, কিংবা যখন তুমি তোমার বিবাহিত রাতের একান্ত মুহূর্তগুলি
তুলে ধরো আমার সামনে দ্বিধাহীন ভাবে। অথচ আমার ইন্দ্রিয় সাড়া
দেয়না, কিংবা হয়ত দিতে পারে না। এমনকি মুখোশের আড়ালেও
ওরা জাগ্রত হয় না।


আমি কিছু দুর্বোধ্য নামের লাল, কালো ফলের ঝোপ থেকে উঠে দাঁড়াই।
তারপর স্যাঁতসেঁতে  পশ্চাৎদেশ শুকিয়ে নিতে নিতে আবার মদে ডুবে
যাই। আমি ক্রমাগত নিজেকে ভাঙতে থাকি। যদিও জানি কালের অসুখ
আমাদের নিকট হতে দেবেনা, তবুও ওরা আমাদের অদৃশ্য হতে সাহায্য
করে অনেকটা রাত্রির অন্ধকারে কালো বস্ত্র পরিহিতের মতন। আমি
আবর্তিত পৃথিবীর মাটি আঁকড়ে ধ’রে  শুয়ে থাকি। আমি কাঁদতে
থাকি এক আবর্তিত পৃথিবীর কেন্দ্রাতিগ তীব্র আকর্ষণে।

ড্রিমস(স্বপ্ন)
ল্যাংস্টন হিউস
অনুবাদ: প্রত্যূষ  কান্তি কর্মকার

স্বপ্নগুলো আগলে রেখো,
স্বপ্ন যেন হারায় না কক্ষনো 
স্বপ্নবিহীন জীবন দিশাহারা 
ডানাভাঙা পাখির মতই,জানো?

স্বপ্নগুলো জড়িয়ে ধরো জোরে,
স্বপ্ন যদি হারিয়ে ফেলো তুমি-
রুক্ষ কঠিন বাস্তবেরই মত

উষর হবে জীবনযাপন জমি। 



বন্দী পাখি(কেজড বার্ড)
মায়া এঙ্গেলো(মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)
 অনুবাদঃশ্যামশ্রী রায় কর্মকার

স্বাধীন পাখি লাফ দিল ঐ
মুক্ত হাওয়ার পিঠে
ভাসতে ভাসতে পৌঁছে গেল
স্রোতের সীমানায়
ডুবিয়ে দিয়ে পাখনাদুটি
সূর্য আগুন রঙে
ছিনিয়ে নিল আকাশ মালিকানা।

বন্দী পাখি দৃপ্ত পায়ে
হাঁটল খাঁচা জুড়ে
গরাদগুলো আটকেছে তার
দৃষ্টিগাড়ীর পথ
পাখনা জুড়ে বাঁধন আঁটা
পায়ে লোহার বেড়ি
অবাধ কণ্ঠে তবুও সপ্ত স্বর।

বন্দী পাখি গাইছে এখন
বুক কাঁপানো সুরে
অজানা সব দেশের কথা
দীর্ঘ যে তার শ্বাস
সুরের খেলা পৌঁছে গেছে
দূর পাহাড়ের দেশে
পাখির গলায় শুনছে সবাই
শিকল ছেঁড়ার গান।

ভাবল পাখি ভাবল এবার এক পশলা হাওয়া
আয়ন বাতাস মিলিয়ে গেল দুঃখী গাছের ফাঁকে
পৃথুল পোকা বসল এসে সবুজ রোদের ঘাসে
আকাশপটের দলিল জুড়ে সেই পাখিটার নাম।

বন্দী পাখির স্বপ্ন ঘুমায় কোন কবরের নীচে
ছায়াটি তার গর্জে ওঠে কোন বিপদের ভয়ে
পাখনা জুড়ে বাঁধন যে তার,পায়ে লোহার বেড়ি
মুক্ত কণ্ঠে গাইছে তবু স্বাধীন হবার গান।

বন্দী পাখি গাইছে এখন
বুক কাঁপানো সুরে
অজানা সব দেশের কথা
দীর্ঘ যে তার শ্বাস
সুরের খেলা পৌঁছে গেছে
দূর পাহাড়ের দেশে
পাখির গলায় শুনছে সবাই
শিকল ছেঁড়ার গান।