Showing posts with label সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা ২০২০. Show all posts
Showing posts with label সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা ২০২০. Show all posts

Wednesday 1 July 2020

অরূপম মাইতির কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০



মানুষের জামা

 অরূপম মাইতি

সখ করে রঙ বদলে সাধারণ হয়েছিলে...

রোদ্দুর মেখে রাস্তায়, কলে দাঁত ধুয়ে চান

আলুর ধুলোতে বিরক্ত না হয়ে বাজারে

কুলকুল ভেসে যাওয়া তরলে মাখানো

টাটকা বা বাসি, হরেক সবজির গন্ধে

হড়কে না গিয়ে, ভয় পিছনে রেখে শির

অবিচল রেখে বাসের পাদানিতে আঙুল

গিঁথে হাসতে হাসতে অফিস পৌঁছে, লজ্জা

না পেয়ে এক-একটা দিন খরচ করেছ

রঙিন হওয়ার আবদারে সামিল না হয়ে

আঁধারকে ভালবেসে, আম আদমির সব

পেখম-তোলা নাচের দৃশ্যে, নিষ্ঠাবান তুমি

যেভাবে ভূমিকা পালন করেছ, তাতে  

রামধনুর সব রঙ ধার করে দিনগুলো

লেখা হয়েছে আমাদের নামে, এক সাথে

ঠিক যেমন আমি, তুমি এবং অন্য সবাই

মানুষের জামা পরে দিন আর রাত কাটাই

Tuesday 30 June 2020

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০







দুপুরের থালায় নদী

হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়


আমরা দুজনেই একটু একটু করে 
খেতে ভুলে যাচ্ছিলাম
তার মানে কিন্তু কখনই এরকম নয়
আমাদের কোনো খিদে ছিল না অথবা
আমরা খাবার চিনতে পারছিলাম না
আমাদের সবই কিন্তু খুব কাছাকাছি ছিল
তবুও খেতে ভুলে যাওয়াটাকে আমরা
জানলা বন্ধের বিপরীত মানে করছিলাম
তাছাড়া খিদেটাকে আমরা দুজনেই 
কেমন যেন কুয়াশা কুয়াশা মনে করতাম
যেন একটা রঙ উঠে যাওয়া কালো পর্দা
সবকিছুর সঙ্গেই জড়ানো আছে

খেতে ভুলে যাওয়ার দ্বিতীয় দিনেই 
আমাদের কেমন যেন দমবন্ধ হয়ে আসছিল
আমরা জানলা খুলতে শিখেছিলাম
আকাশকে দেখে এই প্রথম মনে হয়েছিল
ইজেলে টাঙানো ক্যানভাস
পছন্দমতো যেকোনো রঙে ডুবিয়ে
চোখে টাঙিয়ে নেওয়া যায়
সাদা পাতার মতোই আকাশের সামনে দাঁড়িয়ে
মনে হয়েছিল আমাদের বুকে কথার পাহাড়
আমরা শুরু করেছিলাম অনর্গল কথার সংলাপ

একসময় সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমাদের চোখ
অনবরত ঘুরপাক খেত এখানে ওখানে
তাকাতেই হবে এমন কোনো বিষয় নয়
তবুও চোখ যেন কিছুর সন্ধানে ফিরতো
গর্তের চারপাশে অগণন মাথার সঙ্গে
কখন যেন আরও দুটো মাথা যোগ হয়ে যেত
তখন তো আমাদের এক পাহাড় খিদে

ঝড়ের তাণ্ডব, অবিরাম ধারাপাতের মধ্যে
চোখগুলোকে কি করে একজায়গায় টেনে আনব
এই নিয়ে আমাদের মনে কিছু এসে জড়ো হয় নি
চোখকে যে একবিন্দুতে এনে ফেলা যায় 
শুধু চোখ দিয়েই পড়ে ফেলা যায় জলের সমগ্র অধ্যায়
বিন্দুতে আমাদের কোনো বিশ্বাস ছিল না
খিদেই তো আমাদের চড়কির মতো ঘোরাতো 
কাজের শেষে সাইকেল নিয়ে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে
বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে দাঁড়িয়ে
আমাদের কোনো আকাশের গল্প ছিল না

জানলা খোলার দিন থেকেই আমাদের সূর্যের গল্প এলো 
বটগাছের পাতায় পাতায় রোদ দেখে মনে হলো
আমরা ভালো করে তাকাতেই শিখি নি
খিদের সঙ্গে সঙ্গে অগণন পোকা
উঠোনে জড়ো হয়ে পৃথিবীর মাটিকে আড়াল করেছিল
আর আমাদের ব্যক্তিগত ইমারতের শোভায়
আমরা ভুলে যাচ্ছিলাম আমাদের দাঁড়ানোর প্রসঙ্গ
এখন বিন্দুর ঔজ্জ্বল্যে আমরা ফিরে পাচ্ছি
নগর সংকীর্তনের ভাষা আর সুর 
পথের দুপাশে সাজানো সবুজ বিন্যাসের সঙ্গে
আমাদের বাপ ঠাকুরদার রক্তের সমীকরণের সাদৃশ্য

প্রতিটি ঘরের কোণেই একটা দুটো তিনটে চারটে
খিদে পরপর শুয়ে থাকে নিজেদের নিয়মে
গায়ে গা লাগিয়ে নয়, খিদের মতোই ছোটো বড় হাঁয়ে
রোদ্দুরে পিঠ দেওয়ার মতো করে মনে হয়
ভিজে লোমগুলো শুকনো হয়ে ফুলে ওঠা দেখে
একটু আগেও ওরা হা-মুখের মধ্যে ডুবে ছিল
ছুঁড়ে দিলেও যারা উড়ে যায় না
ঘুরে ঘুরে ঠিক কোনো পথের মাথায় দেখা হয়ে যায়
তখন আবার সেই শূন্য থেকে শুরু হয়
গোগ্রাসে সবকিছু খেয়ে নেবার প্রাণপণ চেষ্টা

যেদিন বাড়ি থেকে অনেকটা দূর পর্যন্ত 
পায়ে হেঁটে এগিয়ে যেতে পারব
পথের হাজার জিজ্ঞাসাতেও 
আমাদের চোখে ঠিকানা থাকবে না 
দাঁড়াবার জায়গার চারপাশ জুড়ে 
দুপুর পা ছড়িয়ে এসে বসবে
সেদিন দুদিকের দুটো নদীর জলে
আমাদের দুপুরের থালা থই থই করবে ।







তাপসী লাহার কবিতা, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০






সেলাই

তাপসী লাহা

অনুবাদের গায়ে শব্দ সেলাই করো
পরিতাজ্য চাদরের
ছেড়াটুকু
বিষমের ভার নিয়ে.. ঘ্রাণ ছড়ায়
যেন  আস্তানা ছিল নদীর চোখে।

অজস্র বছরের  ঘুমগুলো,ছেড়া পুঁথি ডুবে আছে
 কত ইতিহাসে। 

বটের চিহ্নে ঝুড়ি মাখা আজগুবি নালিশ
ডাকছি আবার ... কাহ্নর ভুল সব, পুস্তকের পাশে

একজোড়া ডাহুকের অভিসার,কলমি লতায়
হাসিগুলো ঢেউ তোলে,
 হাসতে হাসতে ভুলে যায়
বিজন ঘরের কবি, স্মৃতিতে ধরে রাখা শেষ দুটো লাইন।
পাতার ফোকরের সিঞ্চনের ছন্দগুলো দুঃখ আঁকে
আস্ত একটি শরীর কোথায় খু্ঁজে ফিরি।

  হাওয়ায় নীরব ভিনদেশী কলমের শ্বাস ফুলে ওঠে

  এরই ফাঁকে,  ছিন্ন চাদর উড়ে গিয়ে আটকে             যায়  অচিন বাঁশের ডগায়।



গ্রিক কবি কিরিয়াকা কারসাম্বার কবিতা ,অনুবাদক উজ্জ্বল ঘোষ ,সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা,২০২০





এখন আর

কিরিয়াকি কারসাম্বা

এখন আর কিছুই আশা করি না আমি।
মন দিয়ে শুনি সব।
জীবন সামনে আসে হাজার রূপে:
প্রকৃতি, মানুষ, জীবজন্তু, পাখি,
সুগন্ধী, সূর্য, বৃষ্টি আরও কত কী!

নানা তথ্য, কান্না, হাসি
অপরিচিতের চোখে ঐশ্বরিক ঝলক,
ঘাতক, বিচারকের অপ্রত্যাশিত করুণা,
প্রিয় কিছু চিরতরে হারিয়ে ফেলা,
ব্যাখ্যাতীত ঘটনাসমূহ,
সহযাত্রীর মুখ-ঝামটা—
এ সবই জীবনের ভিন্ন ভিন্ন রূপ।
হীন ও মহান প্রিয় সব মানব,
ভালোবাসা, নৈঃশব্দ্য—
সকলই কড়া নাড়ে জীবনের দ্বারে।



একমাত্র সাক্ষী

কিরিয়াকি কারসাম্বা

সন্দেহ-সংকটের উৎসে পৌঁছাতে
আমাকে সবকিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
নিজেকে যথাযথ সম্মান জানাতে
এছাড়া উপায় ছিল না আর!
যদিও তুমি জানতে, আমিই ছিলাম
সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সাক্ষী, আর
আমাকে ছাড়া শেষ সিদ্ধান্ত
থেকে যেত অধরা।
অন্য কেউ উপলব্ধিই করতে পারবে না
আমার কাছে এই যাত্রা কতটা আত্মমর্যাদার ছিল।


(গ্রন্থ: প্রায় সত্যের মতো উলঙ্গ, আথিনা ২০১৮)

[ কবি পরিচিতি: পেলোপনিসসের (দক্ষিণ গ্রিস) কালামাতা শহরে ১৯৪৬ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি এশিয়া মাইনর (বর্তমানে তুরস্ক) থেকে আগত এক উদ্বাস্তু গ্রিক পরিবারে জন্ম কবি কিরিয়াকি কারসাম্বা-র (Κυριακή Καρσαμπά)। গ্রিসের আরিস্ততেলিস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি চিকিৎসা-বিদ্যায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। গত ৩৪ বছর ধরে তিনি চিকিৎসা করে চলেছেন গ্রিসের নানা প্রতিষ্ঠানে। রক্ত-বিজ্ঞান (Hematology) নিয়ে তাঁর লেখা গবেষণা-গ্রন্থ অনূদিত হয়েছে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায়। তাঁর মানুষ তথা জীবন দেখার চোখ স্বভাবতই আমাদের থেকে একটু আলাদা। এসব অভিজ্ঞতার আলোকেই রচিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "প্রায় সত্যের মতো উলঙ্গ" (Σχεδόν Γυμνή Σαν Την Αλήθεια / স্খেদন গিমনি সান তিন আলিথিয়া) প্রকাশিত হয় ২০১৮ সালে।]

Sunday 28 June 2020

মৌপ্রিয়া গাঙ্গুলির কবিতা , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০




অসমাপ্তি
মৌপ্রিয়া গাঙ্গুলি 

না, আমি সত্যি জানি না এ গল্পের সমাপ্তি কোথায়!
আর আমি এও জানি না কেনই বা আমরা পরিসমাপ্তি খুঁজি?
সব গল্প কি সত্যি সমাপ্ত হয়?
এই যে আমাদের মনগড়া গন্তব্যে পৌঁছানোর চিরকালীন আকাঙ্খা,
প্রাক্তনদের বারংবার ঘরে ফিরতে চাওয়া!
আমরা প্রত্যেকেই অন্তিম আবার আমরাই শুভারম্ভ...
গল্পেরা শেষ হতে হতেও হয় না শেষ...
লুকিয়ে বেঁচে থাকা গল্পগুলো আবার নতুন গল্পের প্রাণ সঞ্চার করে!
প্রতিদিন প্রতিনিয়ত তারা পৃথিবীর বুকে পুনর্জন্ম নেয়...
অসমাপ্তির ইতিহাসে তাই আমরা আজও হেঁটে চলি, 
জানি না এ পথের শেষ কোথায়! 


অনুপম দাশশর্মার কবিতা 'জলময় প্রণয়' ,সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০


জলময় প্রণয়

অনুপম দাশশর্মা

অনেকদিন পর বাতাসে জলের সোঁদা গন্ধ ভেসে এলে
শানবাধান পুকুরঘাটের সাবানজল চোখে ভাসে।
অবাধ্য মতি নিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ি একটু দূরে। দেখি 
একঝাঁক সাবানের বুদবুদ ঢেকে দিচ্ছে কায়স্থ পাড়ার 
সেরা সুন্দরীর নিরক্ষর দেহ। ভাষাজ্ঞান ছিল না তার, অথচ
যাবতীয় মণিমুক্তো খচিত বিভাজিকায় সে ধারণ করেছে
শ্রাবণের স্রোতধারা দুর্নিবার আকর্ষলতায় সহাস্যে।

নেমে এসেছে সন্ধের শিথিলতা। ঘাটের পাশে কাশবনে
লেগেছে ভাদরের দরদ। আমি কড়া নিশ্বাসে দমিয়ে রেখেছি বুকের হাপর।
কেউ নেই ধারেকাছে তবুও চকিতে
দৌড়ে যাওয়া কাঠবিড়ালিকে দেখে লুকিয়ে পড়তে চাইছে
সাহসী ডান হাত। নরম ঢেউয়ে হিসহিসিয়ে উঠছে যুবতী।

আমি ক্রমশ বন্দি হয়ে চলেছি বৈধতাহীন প্রণয়কথায়।

মন্দিরা ঘোষের কবিতা 'পৌরাণিক' ,সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০




পৌরাণিক

মন্দিরা  ঘোষ

আমাদের পৌরাণিক মাটির বর্ণমালা,
ফুলের গর্ভচক্র, পাখিদের ঔরস  থেকে
শিখে নিতে হবে জারজ জন্মের ভূমিকা

শিখে নিতে হবে  অনার্য রমণীর  ভাষা
তাদের সুমেরুশিখরে ফুটে থাকা বনের আলো
উদ্ধত পুরুষাঙ্গে শাসনের দাসখত
 
এখনো ডিঙি নৌকার  ঘামে
হেসে ওঠে রঙিন বালিমাছ
চতুরতাহীন জলাশয়ে নেমে আসে
ভোরের মেখলা

ওইসব পাথুরে সমাজের গন্ধ
ইতরের ধুলোস্নান মেখে নিতে
জলীয় বাতাস ডাকো
আদিম আয়োজনে  উল্কির মতো
শিশুদাগ গাঁথো
 
এসবই অন্ত্যজ বিকার ভেবে ফিরিও না চোখ
আমাদের উলঙ্গ বিছানায়  সঙ্গমের
নড়বড়ে সেতু
পেরোতে পেরোতে জন্ম ছিঁড়ে যায়

  আজো খাজুরাহো বেয়ে নেমে যায় দ্রাবিড়ের ঘাম
কুর্চির স্নেহে ডুবে আছে বক্ষজ আঁধার
শিশুর গায়ে সোনালি রোদের জামা
জ্যোৎস্নাঠোঁটে  একা একা  কিশোরী কুড়োয় মেঘ
সমস্ত নক্ষত্র  বুকে  রাত রাত সাহসী পুরুষ
দূরে ফসলের আলোয় ডুবে আছে
ঘরনীর সাধ

এসবই নৈমিত্তিক প্রলয়ের  রং
এ বৈদিক  ঘুম ভেঙে গেলে
যজ্ঞঘরে খাক হোক মহাবৃত্তের কূটখতিয়ান

অরণ্যা সরকারের কবিতা , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০



অরণ্যা সরকারের কবিতা


বর্ষা সংখ্যার কবিতা

 

কিছুই সহজ করে নয়

চলে যাওয়া নিয়ে, ফুরোনো নিয়ে, নিরাময়  নিয়ে

এই যে আয়না বসানো, ঘাড় ধরে দাঁড় করিয়ে দেওয়া 

সবই প্রকল্প অধীন

ক্রীতদাসদের স্বপ্ন থেকে ছিটকে আসা ফুলকি

যতবার ফলনের গল্পে নিয়ে যায়

ইঁদুরের অভিজ্ঞ গর্ত থেকে উঠে আসে  গোয়েন্দা দৃষ্টির সিলেবাস

ফুল সেদ্ধ করতে করতে খুঁজি ক্যাচলাইন

পাখি কিনি, ঘরে ফিরি, বাগান করি

কদম, আহা কদমবলে নিভৃত সাজাই

বৃষ্টির কুহক লিখবো ভাবতেই

তথ্যসূত্র হাতে এসে দাঁড়ায় আবহদপ্তর


নেই

 

কাদা প্যাচপ্যাচ স্কুল রাস্তায় সেই কবে

হারিয়ে গেছে ভেজা পেন্সিল

একটানা স্নানে গাছেদের সর্দিলাগা দিন,

কচুপাতায় ঢাকা মাথা, ছিটকাপড়ের ফ্রকে

কাদার বন্দিশ নিয়ে চলে গেছে শ্রাবণসংকেত

চলতহি অঙ্গুলি চাপিসে আমার রাধিকাবসত

শুকনো দোপাট্টায় মুছে রাখে ডানার ব্যাকরণ

মেঘ শুধু সূর্যের না ওঠা, ভ্যাপসা গৃহস্থালি

এই আমি ইচ্ছেমত একান্ন টুকরোয় বাঁচি

তোয়াক্কা করি না

মেনোপজে লকেট করি অ্যাণ্টিক উর্বরতা

বাতিল সেফটিপিনে শুধু কিছু অভিমান

সেইসব থৈথৈ এর দিব্যি

শ্যামশ্রী, আর কোন বর্ষাম্যাজিক নেই

 

কেকা সেনের গল্প 'জলছবি' , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০






জলছবি
                কেকা সেন                

--- মা, আর একটু ভাত দিবি? খুব ক্ষিদে পেইচে রে?
লকাই এর কথায় সুবলা হাঁড়ির ভিতর চোখ পাতে। তলায় যেটুকু ভাত পড়ে আছে, সবটুকু দিয়ে দেয়। 
মনে মনে বলে -- খা বাপ, পেট পুরে খা...
তিনদিন ধরে অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি রানী। আল বাঁধানো নোনা দেহে যেন জল-তরঙ্গের লহর। গত দুইদিন সুবলা নদীতে মীন ধরতে গেছিল। আজ আর যায়নি।শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে তার। নয়তো সেই কবে থেকে এই কাজ করছে সুবলা...হাতে পায়ে হাজা ধরা গতরটা এবার যেন বড্ড কাবু হয়েছে! আজ বড্ড বেশী করে নারান এর কথা মনে পড়ছে সুবলার। নারান... তার ভাতার...যেদিন সেই কালো পাহাড়ের মত সুঠাম দেহটা নদীর পেটে তলিয়ে গেল, তখনও এমন একটানা বৃষ্টি ছিল, বাঁধ-ভাঙ্গা বৃষ্টি।

---- মা জানিস ওই মুখুজ্যে বাড়িতে আবার লোক এইচে।

পলকে তাকায় সুবলা।

--- তুই যাসনি তো আবার ওদের ওখ্যানে?

-- না মা, তুই তো বারন করে দিইচিস!

 চোখ দুটো জ্বলে ওঠে সুবলার

-- আচ্ছা মা, বাবা বুঝি ওদের জমিতেই লাঙল দিত?
-- হ্যাঁ বাপ।
-- ওরা তো এখান থ্যাকি চলি গেইল, তবে?

হ্যাঁ মুখুজ্যেরা তো কয়েক বছর আগেই এখানকার পাততারি গুটিয়ে কোলকাতায় চলে গেছে।  অন্তত সুবলা তো তাই জানে। তবে কিএমন হল যে আবার এক্যানে-- মনে ভাবে সে। 
  
মাইকে সমানে হেঁকে চলেছে, আরও দুদিন বৃষ্টির আভাস। সবাইকে বড় ইস্কুলবাড়িতে উঠে যেতে বলছে।নদীর বাঁধন এবারও বুঝি আর থাকবে না। ক্রমশ জনপথে এগোন নদী যেন ভাঙ্গা -গড়ার জীবন রথের জলছবি। একটা কাপড়ের পুটলি আর লকাইকে নিয়ে সুবলা ইস্কুলবাড়িতে উঠে আসে। পাশে বসা সাদা কাপড়ের মুখখানা বড্ড চেনা ঠেকে তার। পাশের সাদা কাপড়ও করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। মুখুজ্যে গিন্নি! 

--- ছেলেরা, কর্তামশাই মারা যাওয়ার পর আবার এখানে পাঠিয়ে দিলে গো বউ।

পাংশু মুখের শীর্ণ বৃদ্ধাকে দেখে সুবলার দয়াই হল।

---- কিছু খ্যায়েছেন বামুনমা।

বৃদ্ধা দুপাশে মাথা নাড়ে। সুবলা তার পুঁটলির ভিতর থেকে  দুটো মুড়ির মোয়া বার করে হাতে দেয়। বৃদ্ধার চোখের কোনে জল দেখে মুখ ঘুরিয়ে নেয় সে। মনে মনে ভাবে -- সেদিন আমাদের মত ছোট জাতকে এট্টু আচরয় দ্যালি, আমার নারানকে বাঁধ ভাঙ্গা জলি ডুবতি হতনি বামুনদি!

কলকল শব্দে নদীর জল এখন অন্যদিকে বইছে।


রণজিৎ সরকারের গল্প 'আবুবেন আদম' , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা,২০২০

              


আবুবেন আদম               

রণজিৎ সরকার

 

বদন মিত্র রাজ্যের ডাকসাইটে মন্ত্রী, দোর্দণ্ড প্রতাপ। হাই-কম্যান্ডের পরেই যার নাম উচ্চারিত হয়।ফলে দিন দিন নতুন দায়িত্ব, নতুন কাজের চাপ ক্রম বর্ধমান।তিল তিল করে নিজেকে প্রমাণ করেছেন কাজের ছেলে কাছের ছেলে হিসেবে। তার ওপর হাই-কম্যান্ডের অগাধ বিশ্বাস। ওঁর মর্যাদা রাখার জন্য সে সদাই তৎপর। যতই তিনি ওনার কাছের মানুষ হয়ে উঠছেন ততই তিনি নিজের ভেতর একা হয়ে যাচ্ছেন। এত লোকের মধ্যে থেকেও একা। এত স্তাবকের ভীড়ে  তিনি মানসিক অবসাদের শিকার হয়ে উঠছেন ক্রমশ।আর এই অবসাদ কাটানোর জন্য নারীর কোমল স্পর্শে নিজেকে সপে দিয়েছেন। তাঁর শারীরিক সুখ চাই। নিজের উদ্যমকে আরো আরো বাড়িয়ে নিয়ে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছতে হবে। এই তীব্র আকুলতা নিরসনে বেছে নিয়েছেন টলিউডের প্রতিষ্ঠা পেতে চাওয়া নায়িকাদের। চিত্রনির্মাতারা তাদের ব্যবসার স্বার্থে বদনবাবুর গোপন ইচ্ছের আয়োজন করে সরকারী নানান সহযোগিতা পেয়েছেন। আর টলি পাড়ার মেয়েরা গলে গিয়ে বদনবাবুর কামাগ্নি নিভিয়েছে। বদন বাবুর কৃপা হলে তারা একের পর এক সিরিয়ালে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছে, এমন কি সিনেমার নায়িকাও হয়েছে কেউ কেউ।

নাথিং সাকসিড লাইক সাকসেস। পর্দার আড়ালের অন্ধকার কেউ দেখে না। প্রচারের স্পট আলোর ঝলকানির স্বাদ অনেক। একটুখানি কমপ্রোমাইজে কী আসে যায়! শরীরের এটুকু ক্লেদ মেখে যদি দিনের শেষে সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছনো যায় ক্ষতি কী!

              ইদানিং এই নরম শরীরগুলো নিংড়ে তিনি যেন আর আনন্দ পান না ।তবুও অভ্যাস বশে ওদের পাশবালিশ করেন বিছানায়। ঘুম আসে না। পেগের মাত্র বাড়ে। বাড়ে আচ্ছন্নতা। এইমাত্র মেগা সিরিয়াল "অনন্ত আকাশ"এর নায়িকা এরিনা ইয়াশমিনের শরীরে গলানো লাভাস্রোত ঢেলে দিয়েছেন।আজ যেন একটু অন্য আমেজ পেলেন তিনি।অস্ফুট আনন্দ শীৎকারে বলে উঠলেন, ও মাই ডারলিং ইয়াসমিন।

------ইয়েস স্যার।

-----নো স্যার, স্যার বলবে না ডারলিং।

-----কী বলব তবে? ইয়াসমিন বুকের কামনা ক্ষতে ওড়না ঢেকে বিছানায় উঠে বসল।

-----নো নো নো ডিয়ার, এনিথিং এলস ইয়ু ক্যান। তুমি তো অভিনেত্রী, ইজ ইন্ট ইট!

-----আমি তো সংলাপ বলি না।জীবন খুঁজতে এসে জীবন হারিয়ে ফেলেছি।

-----অও নটি, হাউ ফানি ইয়ু আর।তুমি এমন অসহায়ের মত কেন ফিল করছ ডিয়ার। ভগবানের কাছে এলে কেউ অসহায় ফিল করে? তুমি আমার কাছে এসেছ সোনা।

ইয়াসমিনকে ফের বুকে জড়িয়ে ধরে ওর বর্ণহীন ফ্যাকাশে ঠোঁটে যন্ত্রণাদায়ক চুম্বন রাখলেন। শীতল প্রশান্তি অনুভব করছেন তিনি।মনে হচ্ছে আজ ঘুম হবে।ঘুমিয়েও পড়লেন।

রাত কত তিনি জানেন না এখন। হঠাৎ করে তার ঘুমের চটকা ভেঙ্গে গেল। অন্ধকার ঘর। কে যেন হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে।

----কে? ইয়াসমিন!

হাত দিয়ে তিনি সুতোশূন্য পেলব শরীরের স্পর্শ পেলেন। এই তো ইয়াসমিন। তবে কে ইনি?

খুট করে আওয়াজ হল। হালকা নীল আলোয় ঘর ভেসে গেল। আলখাল্লা পরিহিত একটি মানুষ টেবিলে ঝুঁকে পড়ে কী যেন লিখছেন।

বদনবাবু সভয়ে অস্ফুটে বললেন, কে আপনি?

ছায়ামূর্তি ঘুরে দাঁড়ালো, বলল,আমি আবুবেন আদম।

ঈশ্বর আমায় পাঠিয়েছেন। পৃথিবীর সমস্ত চরিত্রহীন মদ্যপ দুর্নীতিপরায়ণ মানুষদের একটি তালিকা প্রস্তুত করছি। আপনিই যোগ্যতম। সহযোগিতা করুন!