Showing posts with label গল্প. Show all posts
Showing posts with label গল্প. Show all posts

Saturday 3 October 2020

রাখী নাথ কর্মকার , ছোটগল্প , সাহিত্য এখন শারদ ২০২০

 


 

 

চ্যাম্পিয়নশিপ

 

আর তো মোটে একটা মাস...তারপরেই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! চারিদিকে কানফাটানো হাততালির শব্দ আর জাতীয় সঙ্গীতের গায়ে কাঁটা দেওয়া সুরেলা, সোনালি মুহুর্তে গলায় সোনার মেডেল ঝুলিয়ে ভিক্ট্রি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে আর কেউ নয়, সোনার মেয়ে বুনাই!      

হ্যাঁ, বুনাইএর শয়নে-স্বপনে-জাগরণে এখন একটাই প্রতীক্ষা-এশিয়ান সাব জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ ! অনেক, অনেক কষ্টে মায়ান্মারে এই ট্রিপে যাওয়ার টাকাটা জোগাড় হয়েছে বাবা মুখে কিছু স্পষ্ট করে না বললেও বাবার চোখের কোণে হতাশার নীল ছায়া বুনাইএর নজর এড়ায় নি। একটামাত্র মেয়ে তাঁর, চাহিদাও তার সামান্য  কিন্তু জীবনের কিছু কিছু মুহূর্তে অদৃষ্টের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া বোধহয় ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মানুষের আর কিছু করারও থাকে না  একটা ছোটোখাটো প্রাইভেট ফার্মে কাজ করেন তিনি সামান্য কটা টাকার বিনিময়ে জীবন থেকে মূল্যবান কিছু মুহূর্ত আর শরীর থেকে অমূল্য কিছু প্রাণশক্তি বাঁধা রাখতে হয় যেখানে  সম্প্রতি মায়ের একটা বড় অপারেশনের পর থেকেই হু হু করে জলের মত টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে  আর তার পরে পরেই এই চ্যাম্পয়নশিপের জন্যে এতগুলো টাকা জোগাড় করা-যাতায়াতের খরচ থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক অনেক খরচই আছে, সেটা খুব একটা কম নয়! নিঃসঙ্গ, আঁধারাচ্ছন্ন রাতে অসহায়ভাবে পথ খুঁজে গেছেন অনিলবাবু বাবার চাপা দীর্ঘশ্বাস বাতাস ছুঁয়ে গভীর হত।  এক একসময় তো বুনাইএর মনে হচ্ছিল - এমন সুযোগটা এবার বোধহয় হাতছাড়াই হয়ে গেল!                

ক্রমাগত জমতে থাকা বিষণ্ণতার ধূসর বাষ্প যখন বুনাইকে প্রায় গ্রাস করে ফেলেছে,  কোথাও একবিন্দু সতেজ বাতাসের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছিল না ও - অফিস থেকে ফিরে এসে অনিলবাবু একদিন আধো আলো, আধো অন্ধকারে এক ঝাঁক জোনাকির মত উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে স্ত্রীকে বলেছিলেন-“দেশের শরিকি জমিটা বিক্রিই করে দেব ভাবছি, বুঝলে! ইচ্ছে-অনিচ্ছের দোলাচলের মাঝে বিভ্রান্ত হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়েছিলেন মিতাদেবী ঐটুকুই তো সম্বল ছিল, ভাড়াবাড়ির অসহায়তার মাঝে ঐ এক্টুকুনি নিশ্চিন্ততার আশ্বাস-সেটুকুও হারিয়ে গেলে… ! পাশের ঘরে হলুদ বাল্বের আলোয় খাটের ওপর বইএর মাঝে মুখ গুঁজে থাকা বুনাইএর মনটা প্রথমে একটু দমে গেলেও পরক্ষণেই মনে হয়েছিল যেন টেনিস রুমের মতই টুপটাপ লাইন দিয়ে ফ্লুরোসেন্ট আলো জ্বলে উঠেছে ঘরের মধ্যে! ভাড়াবাড়ির নোনাধরা দেওয়ালে ছিটকে যাওয়া স্পিড ড্রাইভের একটা আক্রমণাত্মক স্ট্রোক...আর স্ট্রেট সেটে ও হারিয়ে দিতে চলেছে প্রতিপক্ষকে! সেদিন, সেই সন্ধ্যায়, জলভরা চোখে সেই মুহূর্তটাকে খড়কুটোর মত আঁকড়ে ধরে বুনাই ঠিকই করে নিয়েছিল- নাহ, এবার কিছুতেই খালি হাতে ফিরবে না ও               

এমনিতেই এই খেলার জন্যে কম লড়াই করতে হয়নি ওকে  নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে অনিলবাবু্র বড় ইচ্ছে ছিল মেয়ে তাঁর ডাক্তার হবে মধ্যমেধার বুনাই পড়াশুনোয় কিন্তু কোনোকালেই খুব একটা আহামরি কিছু ছিল না বুনাইর খুড়তুতো দাদা বুড়োদা টেবিল টেনিস খেলত ওদের পাড়ারই  ক্লাবে কোথা থেকে যেন সে খেলার নেশাটা চারিয়ে গিয়েছিল মেয়েটার মধ্যেও! মিতাদেবীর অসুস্থ বিকেলটা যখন একদলা অন্ধকার হয়ে নেমে আসত অবশ দুচোখের ফাঁকে, একাকী বুনাই স্কুলফেরত তখন প্রায়ই বুড়োদার টিটি ব্যাটবল হাতে বুড়োদারই সঙ্গে ক্লাবে গিয়ে জুটত ! ফলে, যখন তখন গার্জেন কল, ক্লাসটিচারের চোখ রাঙানি ! বাবার বকুনি ! এর মাঝেই ওকে সাহস জুগিয়েছিল ওদের গেমটিচার মিলিন্দস্যারের সাহচর্য  স্যার বলতেন, সব কাজ কিন্তু সবার জন্যে নয়  প্রতিটি শিশুর মধ্যেই কিছু না কিছুর সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছেসেই সম্ভাবনাটিকেই খুঁজে বের করতে হবে, তারপর তাকে চারাগাছের মত যত্ন করে বড় করে তুলতে হবে! মিলিন্দস্যার বাবাকেও সেকথা বুঝিয়েছিলেন নিতান্ত অবুঝ মানুষটাও সেদিন থেকে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন মিলিন্দস্যারের ঐকান্তিক চেষ্টাতেই কম খরচে এই টিটি কোচিং সেন্টারে বড় বড় কোচেদের তত্ত্ববধানে আজ এতোদূর এগোতে পেরেছে ও, এতবড় সুযোগটা আজ ওর সামনে এসেছে !   

আজকাল তাই বেশ কিছুদিন ধরেই ওর জন্মদিনের কেক, পায়েস কিংবা পুজোর পছন্দের জামা-সবেতেই স্বেচ্ছায় বিস্তর কাটাছেঁড়া করে চলেছে মেয়েটা  এমনকি বিভিন্ন ট্যুর্নামেন্টে জেতা প্রাইজমানি যা ও এতদিন ধরে জমিয়ে রেখেছিল-বড় কোন স্বপ্নের পিছনে খরচ করার জন্যে, সে টাকাও নির্দ্বিধায় বাবার হাতে তুলে দিয়েছে বুনাই  অসুস্থ মায়ের বুকে মাথা রেখে মেয়েটা খুঁজে বেরিয়েছে শুধু একটা  পথের দিশা!   

এখন শুধু সেই স্বপ্নটাকে সফল করার অপেক্ষা দুবছর আগে চেন্নাইতে ইন্টারন্যাশনাল ওপেন টিটিতে ব্রোঞ্জ পেলেও গতবছর ইন্দোরে সাব জুনিয়র সিঙ্গলসে বুনাই জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর থেকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয় নি ওকে। এছাড়াও সিঙ্গলস, ডাবলস, জুনিয়র টিমের বিভিন্ন জাতীয় প্রতিযোগিতায় ধারাবাহিক সাফল্যের মধ্যে তো ও আছেই। ও জানে, যত বেশী ইন্টারন্যাশনাল টুর্নামেন্ট খেলতে পারবে ও, তত ওর অভিজ্ঞতা বাড়বে সেই সঙ্গে এও জানে, এই হার্ডলটা টপকালে ওর মাথার ছোট্ট মুকুটে যে পালকটা যোগ হবে, সেই পালকের ডানায় ভর করেই ওকে পার হয়ে যেতে পারবে হাজার প্রতিবন্ধকতার কাঁটা তারের বেড়া, বাধার সুউচ্চ পাঁচিলএই চ্যাম্পিয়নশিপটা জিতলে ওর সামনে খুলে যাবে বন্ধ দরজার কপাটগুলো এককালের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন অখিলেশস্যারের কাছে অ্যাডভান্সড কোচিং নেওয়ার সুযোগটা অনেক অনেক সহজ হয়ে যাবে আর অখিলেশ ফাউন্ডেশনের বৃত্তিটার জন্যে যদি একবার মনোনীত হয়ে যেতে পারে-তাহলে আর ওকে পিছনে ফিরে তাকাতেই হবে না!   

                                                                                         

টেবিল টেনিস কোচিং থেকে বাড়ি ফিরেই খাটের ওপর এসে উপুড় হয়ে পড়েছিল ক্লান্ত বুনাই ! মিতাদেবী রান্নাঘরে রাতের রান্নার জোগাড় করছিলেন  অনিলবাবু তখনো অফিস থেকে ফেরেননি          

হঠাৎই খাটের পাশে পড়ে থাকা ছেঁড়া খবরের কাগজের ঠোঙার গায়ে একটা ছবিতে চোখ আটকে গেল বুনাইএর  দিগন্তবিস্তৃত জলছবি বানভাসি ঘোলা জলে খেলনার মত জেগে থাকা বাড়িঘরগুলোর মাথায় দাঁড়িয়ে অধীর অপেক্ষায় আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে কয়েকটি ছোট ছেলে !      

নীচে ছোট ছোট অক্ষরে সীমাহীন কষ্টের সাতকাহন! গত কয়েকদিনের তুমুল বৃষ্টিতে পশ্চিম মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলের তলায় তলিয়ে গিয়েছে  সেখানকার বন্যা পরিস্থিতির টুকরো টুকরো খবর আজ সারা দিন ধরেই কানে আসছিল ওর, যদিও দৈনন্দিন ব্যস্ততার মাঝে সেসব নিয়ে আর সেভাবে ভাবার সময় পায় নি বুনাই ! কিন্তু পড়ন্ত বিকেলের ঝিমিয়ে আসা আলোয় এই একটা ছবিই যেন ওর সামনে হাজার গল্পের অমনিবাস খুলে দিল !     

ছবিতে অসহায় ছেলেগুলোর কাতর দৃষ্টি যেন তীক্ষ্ম তীরের ফলার মত! এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয় বুকের ভিতরটা পশ্চিম মেদিনীপুর আর হাওড়ার শখানেক কিলোমিটারের ব্যবধান যেন মুহূর্তে ঘুচে যায়  উতলা হয়ে চেয়ে দেখে বুনাই, বাচ্চাগুলোর চোখে একরাশ প্রতীক্ষা-কখন হেলিকপ্টার থেকে ত্রাণ ফেলা হবে ওদের জন্যে, কখন উদ্ধারকারী দল আসবে ওদের উদ্ধার করে নিয়ে যেতে ! কিংবা কখন একটা ছেঁড়া ত্রিপল, একমুঠো শুকনো চিঁড়ে হাতে উঠে আসবে ওদের,  কখনই বা থই থই জলের মাঝে একফোঁটা খাবার জলের প্যাকেট ঝুপুস করে এসে পড়বে স্কুলের ছাদহা পিত্যেস করে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাগুলোর রুক্ষ, ফাটা ঠোঁটে  স্বস্তির রেখা ফুটে উঠবে    

কেন জানি না, আজ হঠাৎ বীণামাসির কথা মনে পড়ে গেল বুনাইর  বীণামাসি ওদের পাশের বাড়িতে ঠিকে কাজ করত  বছরখানেক আগে, এমনই এক বর্ষায় অসুস্থ মাকে দেখতে কিছুদিনের ছুটি নিয়ে দেশের বাড়িতে গিয়েছিল মাসি সঙ্গে ছিল মাসির একমাত্র ছেলে, বারো বছরের ছোট্টু  সেবারও কয়েকদিনের বৃষ্টিতে নদী ছাপিয়ে উঠে ভাসিয়ে দিয়েছিল সে গ্রামের সবকিছু বন্যায় ঘরবাড়ি হারিয়েছিল গ্রামের অগুনতি মানুষ মাসির ছেলেটি নাকি ত্রাণের খোঁজে বেরিয়েছিল বুকডোবা জলে আর ফেরে নি বীণামাসির ছেলেটা সাঁতার জানত না!      

বীণামাসি অবশ্য কিছুদিন পরে ফিরে এসেছিল একা ! পাগলের মত অবস্থা তখন তার তারপরএকদিন সেও কোথায় হারিয়ে গেল

 

-“মা !”

রান্নাঘরের টিমটিমে হলুদ আলোয় মাথা নিচু করে বসে মিতাদেবী সবজি কুটছিলেন মেয়ের ডাকে মাথা না তুলেই প্রশ্ন করেন -“কী রে কিছু বলবি? খিদে পেয়েছে? টেবিলের ওপর বাটিতে দেখ, ছোলা ভেজানো রয়েছে…”  

মিতাদেবীর মুখের কথা শেষ হয় না, মেয়ে খসখসে গলায় বলে ওঠে -“মা, এ বছর আমি চ্যাম্পিয়নশিপে যোগ দেব না !”

মিতাদেবী প্রবল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে তাকান মেয়ের দিকে অর্থহীন শব্দগুলো পাঁচ বাই চারের আলোআঁধারি রান্নাঘরে ঝোড়ো হাওয়ার মত পাক খেতে থাকে যে মেয়ের সকালসন্ধে খালি একটাই স্বপ্ন, একটাই আশা, একটাই অপেক্ষা - চ্যাম্পিয়নের শিরোপা, সেই মেয়ে আজ বলছেটা কী ?  

-“মা, আমার ট্রিপের টাকাটা ওদের হাতে তুলে দিতে চাই মা…”  

মিতাদেবীর বিহ্বল, বিমূঢ় চোখের অতলে অবাধ্য প্রশ্নেরা হাবুডুবু খেতে থাকে 

-“মা, চ্যাম্পিয়নশিপে যোগ দেওয়ার সুযোগ আমার জীবনে হয়ত আবার আসবে, কিন্তু …” ইতিমধ্যেই মনস্থির করে নিয়েছে বুনাই বুকের ভিতর মোচড় দিচ্ছে না বলা শব্দগুলো ধরা গলায় ফিস ফিস করে ওঠে মেয়েটা-“ঐ বন্যার্ত মানুষগুলো- যাদের প্রাণটুকু নিয়ে জীবন আর মৃত্যু আজ দড়ি টানাটানিতে চ্যাম্পিয়নশিপ শুরু করে দিয়েছে, তাদের জীবনে হয়ত এ সুযোগ আর আসবে না …”  

                                                     -------------------------------------------------------

                                           

Sunday 5 July 2020

মহুয়া মিত্রের গল্প, সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০



গল্প  

মল্লিকার চিঠি
মহুয়া  মিত্র

" শ্রীচরণেষু মা,
                      আমার প্রণাম নিও । জানো, আমার জন্মদিনে তোমার জামাই আমাকে হীরের গয়না উপহার দিয়েছে । এই বাড়ির সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে । শাশুড়িমা আমার পছন্দ মত রান্না করেন, শ্বশুরমশাইয়ের কাছে আমি নিজের মেয়ের চাইতেও বেশি । আর দেওর তো নিত্যনতুন উপহার আনে আমার জন্য ।
         আমি খুব ভালো আছি । তুমিও ভালো থেকো মা ।
                                             ইতি,
                                             তোমার মল্লিকা ।। "

চিঠি শেষ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল মল্লিকা । বলা হল না, অফিস কলিগের সাথে স্বামীর অবৈধ সম্পর্কের কথা বা পণের দাবিতে শাশুড়ীমায়ের অকথ্য গালিগালাজের কথা । শ্বশুরের কুদৃষ্টি বা টাকা চেয়ে না পেয়ে দেওরের দু'ঘা মারার কথাও বলতে পারল না । কারণ চিঠির ঐ মিথ্যাগুলোই যে মল্লিকার জীবনের চরমতম সুখ ।

Wednesday 1 July 2020

মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প 'শরণাগত' , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০


শরণাগত

মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়

 

কাঁদতে-কাঁদতে পথের ধূলোয় লুটিয়ে পড়েছে সারণ্যা ।

ধম্মপাদের আজ অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে । সারণ্যার পিতামাতা তীর্থ ভ্রমণে গিয়ে আর ফেরেনি । না ফেরার কারণ সকলের অজানা । প্রত্যেকে অনুমান করে নিয়েছে তারা দুজনেই জীবিত নেই । সারণ্যাকে ধম্মপাদের মাতার কাছে রেখে তীর্থে গিয়েছিল সারণ্যার পিতামাতা । তাই ছেলেবেলা থেকে তার আর সারণ্যার একসঙ্গে বেড়ে ওঠা । কত খুনসুটি । কঠিন অসুখে একদিন ধম্মপাদের মাতা এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করল । তখন ধম্মপাদের বয়স নয় ও সারণ্যার সাত ।

সারণ্যার দুষ্টুমিতে অতিষ্ঠ হয়ে ধম্মপাদ তার বেণী ধরবার চেষ্টা করলেই তারস্বরে কান্না জুড়ে দিত । আর তার পিতা পুঁথিতেই চোখ নিবদ্ধ রেখে গম্ভীর স্বরে বলে উঠতেন, ‘সুবোধ ছেলেদের এহেন কর্ম্ম শোভা পায় না ধম্মপাদ ।’ কথাটা শুনেই ধম্মপাদ সংকুচিত হয়ে পড়ত । আর সেই সুযোগে সারণ্যা একছুটে কিছুটা দূরে গিয়ে খিলখিল হাসির শব্দ তুলে বনানীর আড়ালে লুকিয়ে পড়ত । আর রাগে ধম্মপাদ শূন্যে আপন দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ছুঁড়ে দিত ।

আবার সারণ্যা যখন নিজে না খেয়ে পাথরের খোরায় তার জন্য অন্ন সাজিয়ে অপেক্ষা করত, তখন ধম্মপাদের মন সারণ্যার সব দুষ্টুমিকে ক্ষমা করে দিত । পুঁথি অধ্যয়ন করতে-করতে নিদ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়লে সারণ্যা তার পুঁথি সযত্নে কুঠুরীতে তুলে রেখে তার মাথায় উপাধান দিয়ে দিত । সারণ্যার করুণাময়ী রূপ ধম্মপাদকে তার মাতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতো ।

   আজ ধম্মপাদের অনেক পুরনো কথা স্মরণে আসছে । নাহ্‌, সে আজ অশ্রুপাত করে অন্তর ভারি করবে না । আজ আসক্তি, মায়া, স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়ার স্পৃহাকে সে পরাস্ত করতে পেরেছে । পিতার আর্তি, সারণ্যার কোমল বাহুডোর উপেক্ষা করেছে । মস্তকের উপর নিশ্চিত ছাদ, সম্মুখে সজ্জিত অন্নের মায়া ত্যাগ করে সে আজ পথে বেরিয়েছে । সে আর সংসারজীবনের ক্ষুদ্র মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে পারবে না ।

সারিপুত্র স্বহস্তে তাকে পাঠদান করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একসময়ে সংসারের আসক্তিতে আচ্ছন্ন ধম্মপাদের আজ সংসারকে বিষবৎ লাগে । সে আজ প্রত্যক্ষ করতে পেরেছে অনন্ত মুক্তির আলো সেই সুকোমল পাদপদ্মে সে নিজেকে সমর্পণ করেছে । কর্ণে দিবানিশি ভেসে আসে ...

“বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি

ধম্মং শরণং গচ্ছামি

সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি ।।”

Sunday 28 June 2020

কেকা সেনের গল্প 'জলছবি' , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা, ২০২০






জলছবি
                কেকা সেন                

--- মা, আর একটু ভাত দিবি? খুব ক্ষিদে পেইচে রে?
লকাই এর কথায় সুবলা হাঁড়ির ভিতর চোখ পাতে। তলায় যেটুকু ভাত পড়ে আছে, সবটুকু দিয়ে দেয়। 
মনে মনে বলে -- খা বাপ, পেট পুরে খা...
তিনদিন ধরে অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি রানী। আল বাঁধানো নোনা দেহে যেন জল-তরঙ্গের লহর। গত দুইদিন সুবলা নদীতে মীন ধরতে গেছিল। আজ আর যায়নি।শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে তার। নয়তো সেই কবে থেকে এই কাজ করছে সুবলা...হাতে পায়ে হাজা ধরা গতরটা এবার যেন বড্ড কাবু হয়েছে! আজ বড্ড বেশী করে নারান এর কথা মনে পড়ছে সুবলার। নারান... তার ভাতার...যেদিন সেই কালো পাহাড়ের মত সুঠাম দেহটা নদীর পেটে তলিয়ে গেল, তখনও এমন একটানা বৃষ্টি ছিল, বাঁধ-ভাঙ্গা বৃষ্টি।

---- মা জানিস ওই মুখুজ্যে বাড়িতে আবার লোক এইচে।

পলকে তাকায় সুবলা।

--- তুই যাসনি তো আবার ওদের ওখ্যানে?

-- না মা, তুই তো বারন করে দিইচিস!

 চোখ দুটো জ্বলে ওঠে সুবলার

-- আচ্ছা মা, বাবা বুঝি ওদের জমিতেই লাঙল দিত?
-- হ্যাঁ বাপ।
-- ওরা তো এখান থ্যাকি চলি গেইল, তবে?

হ্যাঁ মুখুজ্যেরা তো কয়েক বছর আগেই এখানকার পাততারি গুটিয়ে কোলকাতায় চলে গেছে।  অন্তত সুবলা তো তাই জানে। তবে কিএমন হল যে আবার এক্যানে-- মনে ভাবে সে। 
  
মাইকে সমানে হেঁকে চলেছে, আরও দুদিন বৃষ্টির আভাস। সবাইকে বড় ইস্কুলবাড়িতে উঠে যেতে বলছে।নদীর বাঁধন এবারও বুঝি আর থাকবে না। ক্রমশ জনপথে এগোন নদী যেন ভাঙ্গা -গড়ার জীবন রথের জলছবি। একটা কাপড়ের পুটলি আর লকাইকে নিয়ে সুবলা ইস্কুলবাড়িতে উঠে আসে। পাশে বসা সাদা কাপড়ের মুখখানা বড্ড চেনা ঠেকে তার। পাশের সাদা কাপড়ও করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। মুখুজ্যে গিন্নি! 

--- ছেলেরা, কর্তামশাই মারা যাওয়ার পর আবার এখানে পাঠিয়ে দিলে গো বউ।

পাংশু মুখের শীর্ণ বৃদ্ধাকে দেখে সুবলার দয়াই হল।

---- কিছু খ্যায়েছেন বামুনমা।

বৃদ্ধা দুপাশে মাথা নাড়ে। সুবলা তার পুঁটলির ভিতর থেকে  দুটো মুড়ির মোয়া বার করে হাতে দেয়। বৃদ্ধার চোখের কোনে জল দেখে মুখ ঘুরিয়ে নেয় সে। মনে মনে ভাবে -- সেদিন আমাদের মত ছোট জাতকে এট্টু আচরয় দ্যালি, আমার নারানকে বাঁধ ভাঙ্গা জলি ডুবতি হতনি বামুনদি!

কলকল শব্দে নদীর জল এখন অন্যদিকে বইছে।


রণজিৎ সরকারের গল্প 'আবুবেন আদম' , সাহিত্য এখন বর্ষা সংখ্যা,২০২০

              


আবুবেন আদম               

রণজিৎ সরকার

 

বদন মিত্র রাজ্যের ডাকসাইটে মন্ত্রী, দোর্দণ্ড প্রতাপ। হাই-কম্যান্ডের পরেই যার নাম উচ্চারিত হয়।ফলে দিন দিন নতুন দায়িত্ব, নতুন কাজের চাপ ক্রম বর্ধমান।তিল তিল করে নিজেকে প্রমাণ করেছেন কাজের ছেলে কাছের ছেলে হিসেবে। তার ওপর হাই-কম্যান্ডের অগাধ বিশ্বাস। ওঁর মর্যাদা রাখার জন্য সে সদাই তৎপর। যতই তিনি ওনার কাছের মানুষ হয়ে উঠছেন ততই তিনি নিজের ভেতর একা হয়ে যাচ্ছেন। এত লোকের মধ্যে থেকেও একা। এত স্তাবকের ভীড়ে  তিনি মানসিক অবসাদের শিকার হয়ে উঠছেন ক্রমশ।আর এই অবসাদ কাটানোর জন্য নারীর কোমল স্পর্শে নিজেকে সপে দিয়েছেন। তাঁর শারীরিক সুখ চাই। নিজের উদ্যমকে আরো আরো বাড়িয়ে নিয়ে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছতে হবে। এই তীব্র আকুলতা নিরসনে বেছে নিয়েছেন টলিউডের প্রতিষ্ঠা পেতে চাওয়া নায়িকাদের। চিত্রনির্মাতারা তাদের ব্যবসার স্বার্থে বদনবাবুর গোপন ইচ্ছের আয়োজন করে সরকারী নানান সহযোগিতা পেয়েছেন। আর টলি পাড়ার মেয়েরা গলে গিয়ে বদনবাবুর কামাগ্নি নিভিয়েছে। বদন বাবুর কৃপা হলে তারা একের পর এক সিরিয়ালে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছে, এমন কি সিনেমার নায়িকাও হয়েছে কেউ কেউ।

নাথিং সাকসিড লাইক সাকসেস। পর্দার আড়ালের অন্ধকার কেউ দেখে না। প্রচারের স্পট আলোর ঝলকানির স্বাদ অনেক। একটুখানি কমপ্রোমাইজে কী আসে যায়! শরীরের এটুকু ক্লেদ মেখে যদি দিনের শেষে সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছনো যায় ক্ষতি কী!

              ইদানিং এই নরম শরীরগুলো নিংড়ে তিনি যেন আর আনন্দ পান না ।তবুও অভ্যাস বশে ওদের পাশবালিশ করেন বিছানায়। ঘুম আসে না। পেগের মাত্র বাড়ে। বাড়ে আচ্ছন্নতা। এইমাত্র মেগা সিরিয়াল "অনন্ত আকাশ"এর নায়িকা এরিনা ইয়াশমিনের শরীরে গলানো লাভাস্রোত ঢেলে দিয়েছেন।আজ যেন একটু অন্য আমেজ পেলেন তিনি।অস্ফুট আনন্দ শীৎকারে বলে উঠলেন, ও মাই ডারলিং ইয়াসমিন।

------ইয়েস স্যার।

-----নো স্যার, স্যার বলবে না ডারলিং।

-----কী বলব তবে? ইয়াসমিন বুকের কামনা ক্ষতে ওড়না ঢেকে বিছানায় উঠে বসল।

-----নো নো নো ডিয়ার, এনিথিং এলস ইয়ু ক্যান। তুমি তো অভিনেত্রী, ইজ ইন্ট ইট!

-----আমি তো সংলাপ বলি না।জীবন খুঁজতে এসে জীবন হারিয়ে ফেলেছি।

-----অও নটি, হাউ ফানি ইয়ু আর।তুমি এমন অসহায়ের মত কেন ফিল করছ ডিয়ার। ভগবানের কাছে এলে কেউ অসহায় ফিল করে? তুমি আমার কাছে এসেছ সোনা।

ইয়াসমিনকে ফের বুকে জড়িয়ে ধরে ওর বর্ণহীন ফ্যাকাশে ঠোঁটে যন্ত্রণাদায়ক চুম্বন রাখলেন। শীতল প্রশান্তি অনুভব করছেন তিনি।মনে হচ্ছে আজ ঘুম হবে।ঘুমিয়েও পড়লেন।

রাত কত তিনি জানেন না এখন। হঠাৎ করে তার ঘুমের চটকা ভেঙ্গে গেল। অন্ধকার ঘর। কে যেন হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে।

----কে? ইয়াসমিন!

হাত দিয়ে তিনি সুতোশূন্য পেলব শরীরের স্পর্শ পেলেন। এই তো ইয়াসমিন। তবে কে ইনি?

খুট করে আওয়াজ হল। হালকা নীল আলোয় ঘর ভেসে গেল। আলখাল্লা পরিহিত একটি মানুষ টেবিলে ঝুঁকে পড়ে কী যেন লিখছেন।

বদনবাবু সভয়ে অস্ফুটে বললেন, কে আপনি?

ছায়ামূর্তি ঘুরে দাঁড়ালো, বলল,আমি আবুবেন আদম।

ঈশ্বর আমায় পাঠিয়েছেন। পৃথিবীর সমস্ত চরিত্রহীন মদ্যপ দুর্নীতিপরায়ণ মানুষদের একটি তালিকা প্রস্তুত করছি। আপনিই যোগ্যতম। সহযোগিতা করুন!