Showing posts with label গদ্যাবলী. Show all posts
Showing posts with label গদ্যাবলী. Show all posts

Friday 28 February 2020

সাহিত্য এখন ভালোবাসা সংখ্যা,২০২০, গদ্যাবলী









সম্পাদকীয়


কথা ছিল, বইমেলা সংখ্যা হবে সাহিত্য এখনের। কথা তো কতই থাকে। কাজের সঙ্গে তাদের কারও কারও আজন্ম বৈরিতা। এই যে আমাদের সবার প্রিয় নবনীতা দেবসেন, চলে যাওয়ার কথা ছিল কি তাঁর? অসুখকে ‘কামেন ফাইট’ বলে যুদ্ধ ঘোষণা করে কেউ কি চলে যায় এভাবে? ছোটবেলা থেকে যে আমরা গেয়ে আসছি ‘বিন্ধ্য হিমাচল, যমুনা,গঙ্গা…’ , আর এক অখণ্ড ভারতের চিত্র ফুটে উঠছে আমাদের মনের পাতায়- তার কি এমন ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকার কথা ছিল? ছিল না তো। মনে আছে, ছোটবেলায় যখন ত্রিবর্ণ পতাকার তলায় সার দিয়ে দাঁড়িয়ে উড়ন্ত মেঘের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে জাতীয় স্তোত্র উচ্চারণ করতাম, এক প্রচ্ছন্ন গর্ব এসে বুক ভরিয়ে দিত। বিশ্বাস করতাম, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে কোল পেতে দেওয়া আমাদের দেশ আমাদের মা। খ্রিস্টান বন্ধুর সঙ্গে গির্জায় বসে ক্যারল শুনতে শুনতে, মুসলিম বন্ধুর সঙ্গে ইদের সিমুই খেতে খেতে, চায়েজীর হাতে গুরুদ্বারের প্রসাদী হালুয়া খেতে খেতে একসঙ্গে বড় হওয়া আমরা এত সহজে ভালোবাসার শিকড়কে ভুলে যাব? ভুলব না বলেই এই সংখ্যার নাম দেব ভালোবাসা। আমাদের দেশকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে চাইলে আমরাও বলব, ‘কামেন ফাইট’। হার মানব না কিছুতেই।
                            শ্যামশ্রী রায় কর্মকার



                                                           প্রবন্ধ


দার্জিলিংএর ট্যুরিস্ট  
ঞ্জীরা সাহা



ভানু ভবনের উল্টোদিকের ফুটে  বেশ ভিড়  ট্র্যাফিক পুলিশ সিগনালপরপর গাড়ি গাড়ি থেকে নামা ট্যুরিস্ট লাগেজ ব্যাগ, বাক্স, হ্যান্ড ব্যাগ, রুকস্যাক, ট্রলি , জলের বোতল
কুয়াশা কেটে রোদ উঠেছে আজ সূর্যোদয়ের সময়ে টাইগার হিলে পৌঁছে যাওয়া ট্যুরিস্টরা যত খুশি ফটো তুলে নিয়েছে। বেলা বাড়তে বাড়তে ফেসবুকের পাতায় শতশত লাইক কমেন্ট পড়ে গেছে।
ভোর থেকেই  আজ কাঞ্চনজঙ্ঘা তার পুরো শরীর খানা হাট করে মেলে ধরেছে ট্যুরিস্টদের সামনে। টয় ট্রেনের প্যাঁচে প্যাঁচে নানান কোন থেকে সাদা ঝলমলে কাঞ্চনজঙ্ঘা বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা যাচ্ছে আজ সারাদিনদার্জিলিং এর রাস্তায় ,ভিউ পয়েন্টে এদিক ওদিক কান পাতলে ‘ওয়াও’ , ‘নাইস’,‘বিউটিফুল’ শব্দগুলি ভেসে বেড়াচ্ছে।
বেলা বাড়ার সাথে সাথে ঝলমলে রোদে কাঞ্চনজঙ্ঘা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।  ভানু ভবনের দিক থেকে উলটো ফুটে তাকালে দেখা যাচ্ছে গাড়ি গুলি স্টার্ট দিয়ে চলে যাচ্ছে। সমতল থেকে আসা ট্যুরিস্টরা গাড়ি থেকে নেমেই হঠাৎ করে দার্জিলিং এর ডিসেম্বর শেষের হাড় কাঁপান শীতটা টের পাচ্ছে। রাস্তার মধ্যে ব্যাগ বাক্সের চেন খুলে শীতের পোশাক খোঁজাখুঁজি করছে হুড়মুড় করে বার করতে গিয়ে একটা দুটো পড়ছে নীচে। তুলছে আবার ধুলো ঝেড়ে। ঠান্ডায় অবশ প্রায় হাত দিয়ে ঝাড়তে গিয়ে ভালো ঝাড়তে পারছেনা।  এ তাকে , ও অন্যকে দোষারোপ করে যাচ্ছে।
 পরপর গাড়ি আসছে। একেকটা  গেলেই নতুন নতুন  ট্যুরিস্ট দেখা যাচ্ছে। মোটা মোটা জাবদা পোশাকের ট্যুরিস্টদের ফাঁক দিয়ে ঝলমলে রোদে কতগুলো ময়লা শরীরও দেখা যাচ্ছে। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ফুটপাথের উপর বসা কথার মাঝে মুখ থেকে গুটখা বা ওই জাতীয় কিছুর কালো কালো থুথু ফেলছে ফুটপাথের দিকে। কাঁধে ঝুলছে মোটা মোটা দড়ি । দু তিনগাছি দড়ি  কাঁধের কাছে এসে জোড়া। ওই জায়গাটায় চামড়া মোড়া। চামড়াগুলো ঘষায় ঘষায় ফেটে ফেটে গেছে। গায়ের উপর মোটা মোটা কাছার দড়ির ফাঁকে দেখা যাচ্ছে কারোর ঢিলে প্যান্টের উপর কোঁচকানো সোয়েটার চাপানো। কনুইএর কাছে ফেটে উল বেরিয়ে আছে।  কারুর চুরিদারে অন্য রঙের সুতো দিয়ে রান সেলাই দিয়ে জোড়া। কারুর ঢোলা ঢোলা প্যান্টের নীচে ময়লা ময়লা পা ঢাকা জুতো। গায়ের রঙ গুলোর উপর তামাটে ময়লার পরত পড়া। মুখের চামড়া গুলো ভাঁজে ভাঁজে কুঁচকে গিয়ে সারা মুখ কেমন এবড়ো খেবড়ো। ওদের দু একজন মেয়ের ওই কোঁচকানো চামড়ার মধ্যে একটা গয়না চোখে পড়ছে। নাকের নীচে ফুটো করে বড় বড় পিতলের নাকের দুল ঝুলে পড়ছে ঠোঁটের উপর।  পরপর ট্যুরিস্ট গাড়ি গুলি এসে ওখানে দাঁড়িয়ে পড়ছে। কিছু সাঁ সাঁ করে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে। যারা ম্যালের গা ঘেঁষে হোটেল নিয়েছে ,তাদের এখানেই গাড়ি থেকে নেমে যেতে হবে।
নিউ জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি থেকে  গাড়ি এসেছে কোলকাতা আর আশেপাশের শহরতলীর বাসিন্দাদের লোড করে নিয়ে। বাকিরা অন্য রাজ্য থেকে। স্কুলগুলিতে ক্রিসমাসের ছুটি চলছে। ডিসেম্বরের এই ক্রিসমাসের ছুটি কাটাতে হু হু করে ট্যুরিস্টদের ভিড় বাড়ছে দার্জিলিংএ।  উত্তরবঙ্গগামী ট্রেন গুলি ঠাসা ট্যুরিস্ট নিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি এসে পৌঁছে যাচ্ছে । চারমাস আগেই রিজার্ভেশন ফুল তারপর গাড়ি। প্ল্যান প্রোগ্রাম আগে থেকেই ঠিক করা। বাতাসিয়া লুপ ,ঘুম মনেস্ট্রি্‌রক গার্ডেন মিলে সেভেন পয়েন্ট ঘুরতে হবে  দুই কি এক দিনে। তারপর গ্যাঙটক কি পেলিং।  টাইগার হিলে সানরাইজ। পয়েন্টে পয়েন্টে ফটো। পাহাড় ,গাছ, ফুল ,পাখি্‌ ,আইসক্রিম, গাড়ি-ঘোড়া সব কিছুর সাথে নিজের মুখ।  সব কটা পয়েন্টের আগে এসে গাড়িগুলি পৌঁছল এই ভানু ভবনের সামনে। রক গার্ডেনের ঝর্ণা ,অর্কিড্‌ , জু গার্ডেনের বাঘ ভাল্লুক সব কিছু দেখার আগে এখানে দড়ি ঘাড়ে ময়লা ময়লা মানুষ গুলোর সাথে দেখা হয়ে যাচ্ছে প্রথমে
  ম্যালে কোনও গাড়ি ঢুকতে দেওয়া হবে না। তাই গাড়ি করে লাগেজ হোটেল অবধি পৌঁছবে না। লাগেজ নিয়ে হোটেল অবধি যেতে হবে। ওই যে ওরা দড়ি কাঁধে দাঁড়িয়ে বা বসে আছে - ওরা ট্যুরিস্টদের জন্য অপেক্ষা করছে। ওরা কুলি। এই দার্জিলিং পাহাড়ের খাদের নীচের দিকে ওরা বস্তির ঘরে থাকে। খাড়াই পথে উঠে আসে।  ভোর বেলা অন্ধকার থাকতে যখন ট্যুরিস্ট গাড়িগুলি টাইগার হিলের সানরাইজের দিকে রওনা হয়েছিল ,ওরা শুরু করেছিল ওদের কাঠ আর টিনের চালার জোড়াতালি দেওয়া ঘর থেকে।  খাড়া পথে ম্যালের দিকে। কাঁধ বুক মাথা সামনে দিকে ঝুঁকে পড়ে। পায়ের পাতা গুলি পাথুরে মাটিতে আকাশের দিকে নানা কোণে পড়তে থাকে। ওদের কারুর পিঠ আরও একটু বেশি ঝুঁকে পড়ে মাটির দিকে। পিঠে কাপড়ের মধ্যে ঘুমন্ত বাচ্চাকে বেঁধে নেয়। আঁকা বাঁকা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কতটা খাড়াই পথে কতটা মাথা ঝুঁকিয়ে ওরা উঠে আসে সেটা আমাদের মতো সমতলে থাকা শহুরে ট্যুরিস্টদের দৃষ্টিগোচর হওয়া সম্ভব নয়। কারণ ঠিক সেই সময়ে এই দার্জিলিং এ আসা ট্যুরিস্টদের  চোখগুলি থাকে সাদা বরফের উপর লাল সূর্যোদয়ের দিকে ,অর্কিডের দিকে বা হোটেলের বন্ধ ঘরে বন্ধ অবস্থায়। ওরা হেঁটে আসে  ম্যালের আশেপাশের নীচের খাদ থেকে।  ওই বস্তির ওদিকে ট্যুরিস্ট যায় না টাইগার হিলে তখন সানরাইজ হয়ে যায়। স্লিপিং বুদ্ধা আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। ক্লিক হয় পরপর। লাইভ ভিডিও শেয়ার হয় ফেসবুকে। বা মেঘ এসে যায় । হা হুতাশ শোনা যায় টাইগার হিলের চূড়ায়। গাড়ি গুলি ডিজেল পেট্রোলের ধোঁয়া ছেড়ে নেমে আসে পাহাড়ের গা বেয়ে। জ্যাম হয়ে যায় পাহাড়ি রাস্তায়। গাড়ি থেমে যায় । বদ্ধ গাড়ির  ভেতর বসে ঝিমোতে ঝিমোতে ট্যুরিস্টরা বিরক্ত হয়ে ওঠে। রাগ ,বিরক্তি, দোষারোপ চলে নিজেদের খাঁটি মাতৃভাষায়। কাঞ্চনজঙ্ঘা মেঘ সূর্যকে কাছে না পেয়ে ওই উঁচু পর্বত ঝর্ণা নদী’র পাশের মানুষ গুলোকে দোষারোপ করতে থাকে।  গাড়ির কালো ধোঁয়ায় পাশের ঘন সবুজ জঙ্গল ভরে ওঠে। এদিকে ওই খাদ  থেকে ওরা হাঁটতে থাকে উঁচুর দিকেওখানে নিঃশ্বাস পড়ে জোরে জোরে।
জয়েন্ট ফ্যামেলি আত্মীয় স্বজন পিসতুতো মাসতুতো ভাইবোন ,আশে পাশের প্রতিবেশী বন্ধুবান্ধবের দলবল, নানা দল নামছে ওই ভানুভবনের সামনে। লাল একটা সুমো এসে দাঁড়ালো এইমাত্র।  ড্রাইভার গাড়ির মাথায় উঠে পড়ে উপর থেকে ভারী ভারী ব্যাগ বাক্স গুলি দিয়ে দিচ্ছে নীচের দিকে।  দুই ভদ্রলোক নীচে দাঁড়িয়ে তদারকি করছেওগুলোর দিকে হাঁ করে তিনজন মহিলা তাকিয়ে আছে। ওই ফুটে দড়ি কাঁধে পুরুষ মহিলাদের চোখগুলিও ওই লাগেজের দিকে। ওই তিন মহিলার মধ্যে লাগেজ সামলাতে যে বেশি ততপর হয়ে উঠেছে  ,সে জিন্সের উপর এক খানা কালো প্লাস্টিকের জ্যাকেট পরে নিয়েছে গাড়ি থেকে নেমেই চেনটা টানতে গিয়ে কিছুক্ষণ টানা হেঁচড়া করে ছেড়ে দিয়েছে। পেটের কাছটা আঁট হয়ে চেনটা আর গলা অবধি ওঠে নি। বুকের কাছটা ফাঁকা হয়ে আছে। প্লাস্টিকের জ্যাকেটের হাতার নীচ দিয়ে শাঁখা পলা বেরিয়ে এসেছে বাইরে। গলা মাথায় প্যাঁচানো উটুপির ভেতর থেকে  ভদ্রমহিলা চ্যাঁচাচ্ছে।
-আরে সামালকে সামালকে। দেখতে পায় না যেন। ঠিক করে নাওনা ওদের হাত থেকে। ঠিক সে! ঠিক সে! আরে গির যায়গা এক্ষুণি
উত্তরে পুরুষ কন্ঠের গলাটা কাঁপছে, নিচ্ছি তো !
হ্যাঁ হ্যাঁ ওইটা দিন। এদিকে এদিকে।
ফুটে বসা লোজনের থেকে এক দড়ি কাঁধের মেয়ে লাগেজের দিকে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে এলো এই বৌটুপি প্যাঁচানো স্থুলকায় মহিলার দিকে। রোগা কাঠের মতো চেহারা। ঠোঁটে লেগে আছে শুকনো গুড়াকু। চোখগুলো ঘোলা। গায়ের রঙটা পোড়া। ধুসর রঙ ওঠা চুড়িদারের উপর বেগুনী কোঁচকানো একটা সোয়াটার।
ভাঙা ভাঙা খড়খড়ে গলায় খুব আস্তে আস্তে বলছে, সামান ছোড় দে আস্‌বো হোটেল তক্‌?
গলার স্বরে উচ্চতা থাকলেও একটা কাঁপুনি আছে গলায়। সেই কাঁপা কাঁপা গলায় ভদ্রমহিলা বলছেন, আরে! এ আবার কোত্থেকে? কি চাই হ্যাঁ হ্যাঁ?
হঠাৎ আরও একটু গলা তুলে, এই ব্যাগ গুলো গুনেছ সব? আমার হ্যান্ডব্যাগটা নামিয়েছ সিট থেকে?
কথায় বোঝা যাচ্ছে মহিলা এই আগত মেয়েটির পেশা বুঝতে পারেন নি। সমতলে কোনও মহিলাকে এই কাজে খুব একটা দেখা যায়না তাতে আবার ‘স’ ‘স’ মেশানো ভাঙা হিন্দির ভাষাটা না বুঝে পড়েছে আরেক ঝামেলায়।
আরে লাগেজ গুলো গোনো না সব ঠিক করে। কোনটা চোখের সামনে থেকে ফস করে হাওয়া হয়ে যাবে দেখবে।
মেয়েটি আরও একটু ওই মহিলার কাছে এগিয়ে এসে, সামান দিয়ে আসবো হোটেল? সামান দিজিয়ে দো’শ  দিও
বলেই ট্রলিতে হাত লাগিয়ে ফেলল।
-ওয়া…ক ,ও…য়াক…
-আরে কি হল? ভদ্রলোক লাগেজ ফেলে এগিয়ে এলো সেই জ্যাকেট পরা মহিলার দিকে, এই জার্নিতে মোশনে বমি হচ্ছে।
ভমিটিং এর ওষুধ খাওনি নিশ্চয়ই!

গলা খাঁকড়ে নিয়ে ভদ্রমহিলা রুমাল দিয়ে ঠোঁট থুতনির বমিগুলো মুছতে মুছতে লাগেজের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক করে রেট বল। ফাজলামি করছে ।এই ক’টা মাত্র লাগেজ দিয়ে আসবে আর এতো টাকা!
-কোতো দেবেন? ডেড়শো রুপিয়া দে দিজিয়ে
-কম করো গো । এক’ দেবো। চলনা হ্যাতো চলো চলো।
মাঝামাঝি কোনও একটা সংখ্যায় রফা হয়ে গেল মাল গুলির মালকিন আর বাহকের মধ্যে।
কাঁধের দড়িটা নামিয়ে মেয়েটা দড়ি দিয়ে আঠাশ ছাব্বিশ ইঞ্চির চাকা লাগানো ট্রলি গুলো ধীরে ধীরে বাঁধতে থাকলো ওর দড়িতে। পুরুষ মহিলা দর্শকেরা হাঁ করে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল মাল গুলির দিকে। আটকে নিল তিনটে ট্রলি ওর মোটা কাছার দড়ির নীচে। কপালের উপর মাথার দড়িতে চামড়া লাগানো জায়গাটা সেট করে নিল। ওর পিঠে ঝুলে পড়ল আঠাশ ছাব্বিশ ইঞ্চির তিনখানা ট্রলি। ফাটা চামড়ার ভেতর পেছনের ওজনের ভাড়ে দড়ির চামড়ার ভেতরের ন্যাকড়া গুলো আরো একটু বাইরে বেরিয়ে এলো। মাথাটা ঝুঁকে গেল অনেকটা। কাঁধে পরপর তিন খানা লেডিস ব্যাগ ঝুলিয়ে নিল। লেডিস ব্যাগের সামনে আরেক লেডিস ব্যাগলাল হলুদ ব্রাউন। প্রথমে লাল ব্যাগটা এই কুলি মেয়েটির কাঁধে দেখে হঠা মনে হচ্ছিল যেন একটা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে নেপালি মেয়ে অফিস যাচ্ছে। তারপর ব্যাগের উপর ব্যাগ। নানান সাইজের ব্যাগ। লাল হলুদ ব্রাউন মিলে মিশে গিয়ে কিরকম একটা অন্যরকম হয়ে গেল ছবিটাকলকাতার রাস্তায় এতোগুলো ব্যাগ নিয়ে কোনো মহিলাকে আজন্ম কাল দেখেছি কিনা মনে পড়ছে না।  আরেক হাতে কাল রাতে খাবার শেষ হওয়া এঁটো টিফিন কারির ব্যাগ।
দলটা চলল ম্যাল রোড ধরে ম্যালের ফাঁকা গোল জায়গাটার দিকে। যেতে গিয়ে উঠছে রাস্তাটা উঁচুর দিকে । পিছনে ওই দলটির তিন মহিলার স্পিড কমছে পাবলিক টয়লেট অবধি এসে তিন মহিলা পিছিয়ে পড়ল।
 নিউ জলপাইগুড়ি থেকে বদ্ধ গাড়িতে পাহাড়ে উঠে এসে হঠাৎ করে এই কনকনে শীতের দু তিন ডিগ্রি টেম্পারেচারের মধ্যে নেমে পড়ে পা গুলো যেন পিছিয়ে যাচ্ছে ওদেরকিরকম হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে গায়ের শাল সোয়েটার মাফলার চাদর গ্লাভস  ঠিক করতে করতে
ম্যালে ব্যান্ড বাজছে। ক্যামেরা ঘুরছে। শ্যুটিং চলছে ক্যামেরার ফোকাস মহাকাল মন্দিরের সামনের মঞ্চটায় নাচতে থাকা মেয়েদের দিকে। এই দলের শেষ মহিলার চোখ দলের একদম সামনের সেই দার্জিলিং এর মেয়েটির দিকে। যার পিঠে ওদের নিজেদের ট্রলি ব্যাগ হ্যান্ডব্যাগ। ঝুঁকে পড়া মাথার নীচে ডান পা’টা এগিয়ে এসে স্টেপ ফেলার সাথে সাথে কেডসের সামনের ফুটো থেকে বারবার বুড়ো আঙুলটা বেরিয়ে আসছে বাইরে সবার আগে এই কুলি মেয়েটি তার পেছনেই বাকি তিন জন পুরুষ তারপর তিন জন মহিলা দুটি এগারো বারো বছরের বাচ্চা ছেলে। পরিবারের সবাই পিছিয়ে পড়ছে। দলের ভেতর বারবার ঘুরে ফিরে আসছে একটা কথা,‘অফফফ কি শীত! হু হু হু হু...। ওহো... কি ঠান্ডারে বাবা।‘ শ্যুটিংএর আওয়াজের মাঝেই শোনা যাচ্ছে বাচ্চা গুলোর কথা। ‘কি রে কেমন ঠান্ডা লাগছে? আরে সেলফি-স্টিকটা এনেছিলি?’ বড়দের গলায় ‘এন্টাসিড কেনা হয়েছিল?’। সেই ভদ্রলোকদের তিনজন দার্জিলিং এর হোটেল নিয়ে আলোচনা শুরু করল কাঁপুনির ভেতরেও হা হা হা হা করে খানিক হাসির আওয়াজ লাভ-ক্ষতি ,হার-জিত অনেক কিছুর আলোচনা।
হঠাৎ কোথা থেকে মেঘ কুয়াশায় ঢেকে গেল ম্যাল। হোটেল চ্যালেট পাস করার সময় সবাই যে যার কথা থামিয়ে দিল। কী হচ্ছে ওখানে?
এদিক ওদিক বাচ্চা কালো সাদা ব্রাউন ঘোড়া  ট্যুরিস্ট রঙীন রঙীন বল বেলুনের মাঝখানে যার দিকে চোখ চলে গেল, একটু বয়স্ক মতো মহিলাটি। বেঁটে। মুখে অজস্র ভাঁজ। ভ্রুর নীচের ভাঁজের ভেতরে প্রায় ঢেকে যাওয়া চোখ দুটি রাগে টকটকে লাল হয়ে আছে। ভ্রুর নিচে ঝুলে পড়া চামড়ার ভিতর থেকে চোখগুলি টেনে টেনে বড় বড় করে তাকাচ্ছে। সেইরকম চামড়া মোড়া মোটা মোটা দড়ি রয়েছে ওনার সাথেওদড়ি গুলি এলোমেলো ভাবে দু হাতে ধরা সেই দড়ি হাতে নিয়েই ছোটাছুটি করছে। চিৎকার করছে প্রচন্ড।
ম্যালের চ্যালেট হোটেলের গেট। ট্র্যাডিশনাল কাঠের হোটেল। সবুজ রঙ। ঢোকার মুখটা ত্রিভুজ আকারে কাঠের ছাউনির তলায়। ওই বৃদ্ধা সাজানো গোছানো সেই গেটের দিকে একবার যাচ্ছে আবার কিছুটা ফিরে আসছে ফাঁকা জায়গাটার দিকে। ওই গেটের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কিসব বলে চলেছে। চিৎকারের ভাষাগুলো বোঝা যাচ্ছে না। ভাষাটা একেবারে আলাদা। উত্তেজনাতে আরো কিছু বোঝা যাচ্ছেনা ওর কথাগুলো। হয়তো ধীরে সুস্থে বললে বোঝা যেত খানিক। ওই হোটেলের গেটের মুখে একদল ট্যুরিস্ট। বোঝা যাচ্ছে  এক্ষুণি এসে পৌঁছেছে হোটেলে। হোটেলের গেট থেকে লাগেজ গুলো সেই দলের নির্দেশে মেনে হোটেল বয় নিয়ে যাচ্ছে ভেতরে। ওখানে সব কিছু চুপচাপ চলেছে। এই বৃদ্ধা গেটের দিকে এগিয়ে গিয়ে আরও বেশি করে চ্যাঁচাচ্ছে।  উত্তেজনায় ওর গা হাত পা কাঁপছে। অজস্র ফুটো ভরা ময়লা স্কার্টটা দুলছে ওর জোরে হাঁটার সাথে সাথে। ছুটে গিয়ে কিসব বলেই চলেছে ওদের দিকে তাকিয়ে। বোঝা যাচ্ছে ওই বৃদ্ধা কুলি ওই চ্যালেট হোটেলে নতুন আসা ট্যুরিস্টদের  উদ্দেশ্যে কিছু বলছেওরা চুপ। ভাষাগুলো শুনে মনে হচ্ছে ও ওর ভাষায় গালাগাল দিচ্ছে প্রতিটি বাক্যের শেষেগলার জোর বাড়ছেগলা চিরে চিরে আওয়াজ বেরোচ্ছে ওদের দিকে তাকিয়ে। তাতেও নির্বাক শ্রোতা। পুরো ব্যাপারটা দেখে আন্দাজ করা যাচ্ছে ওই বৃদ্ধা কুলির কাজ হোটেল অবধি মাল পৌঁছে দেওয়া ছিল। সেটা পৌঁছে গেছে। এবার এই গোলমালটা দেনা পাওনা নিয়ে। খুব সম্ভাবনা ওর দাবী করা টাকা এরা দেয়নি। এর একলার অনেক চিৎকারেও বিরোধী পক্ষের  কোনও সাড়া নেই।  
খোয়া...ক!
খোয়া...ক!
মুখ থেকে থুথু বার করছে।
থুঃ... থুঃ...!
 জোরসে ছেটাচ্ছে। যতোটা জোরে পারা যায় ছিটিয়ে দিচ্ছে গেটের দিকে মুখ করে। যতটা থু থু মুখ পেট গলা খাকড়ে বার করতে পারা যায় সবটুকু যেন বার করে আনছে। ছিটিয়ে চলেছে। কুয়াশায় শূণ্যে ছড়িয়ে পড়ছে ওর থুথু।
গেটে এবার শ্রোতাদের আর দেখা যাচ্ছেনা। গেট করিডর ফাঁকা। মাল গুলিও একটাও নেই। ট্যুরিস্টরা ঢুকে গেছে ভেতরে। নিশ্চয়ই এতোক্ষণে রিসেপশনে নয়তো যে যার রুম হিটার চালানো গরম রুমেসিল্ড প্যাকড সাবান শ্যাম্পু পেস্ট ব্রাশ। সাদা ঝকঝকে টয়লেট। নয়তো ফ্রেশ হচ্ছে বাথরুমে ম্যালে শোঁ শোঁ করে হাওয়া বইছে। বৃদ্ধা কুলির গুটখা খাওয়া কালো কালো দাঁত ঠোঁট থুতনি নড়ে চলছে এখনো। দার্জিলিং এর এই উঁচু খোলা যায়গাটায় ফাঁকা পেয়ে বরফের হাওয়া ডানে বায়ে যেদিক সেদিক ঘুরে বেড়ানোর মহা সুযোগ পেয়েছে। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া  বৃদ্ধা কুলির ফুটো ফুটো স্কার্ট  কান মাথা ঘাড়ে ধাক্কা মেরে হু হু করে বয়ে চলেছে। চিৎকারটা চ্যালেট পেরিয়ে বিলিতি মদের দোকান পেরিয়ে আইসক্রিম পার্লার হয়ে শুটিংএর ব্যান্ডের আওয়াজ ছাপিয়ে চলে আসছে । বিদেশী নামের রেস্তোরাঁটার সামনে থেকে পিছন ঘুরে তাকালে দেখা যাচ্ছে ও চেঁচিয়েই চলেছে, থুথু ছিটিয়েই চলেছেমাঝের কুয়াশা মেঘটা সরে গেল এবার । ওই বৃদ্ধা কুলির দিকে পেছন করে  ক্যামেরা মেকাপে ঢাকা সুন্দরী মেয়েদের দিকে ক্যামেরা ফোকাস করে রয়েছে এখনও। ব্যাকগ্রাউন্ডে সাদা ঝকঝকে কাঞ্চনজঙ্ঘা আবার রোদে ঝলমল করে উঠেছে
দলটা সিমেন্ট বাঁধানো ঝরনা পেরিয়ে জাকির হোসেন রোডের মুখের দিকে এগোচ্ছে। আবার কথা শুরু হয়েছে নিজেদের মধ্যে। পুরো পথে নির্বাক শুধু একজন  ওই কুলি মেয়েটি। সেই দরদামের সময় কথা শোনা গেছিল, পুরো পথে আর কোনও আওয়াজ নেই গলায়। একই স্পিডে হেঁটে যাচ্ছে ও। মাথাটা কেবল আরও ঝুঁকে পড়েছে। ওর ঝুঁকে পড়া মাথার সামনাসামনি ওরকম ঝুঁকে পড়া ঠিক আরেকটি মাথা এগিয়ে আসছে ওর দিকে। মাথাটা দেখে বোঝা যাচ্ছে এর বয়সী মেয়েরই মাথা। মাথার কাছে তার দড়িটা প্লাস্টিকের চট মোড়া। ক্রস করছে দুজনকেউ কারুর দিকে তাকাচ্ছে না। দুজনের চোখ রাস্তার পিচের দিকে একভাবে। নিশ্চুপ ভাবে দুজন ক্রস করে গেল। ম্যালের দিকে চলে যাওয়ায় নতুন কুলিটির পিছনটা দেখা যাচ্ছে এবার। মেয়েটির পিছনে একটা গ্যাস সিলিন্ডারের নীচে আরও একখানা গ্যাস সিলিন্ডার। দড়ি বাঁধা অবস্থায় মাথা থেকে ঝুলছে। দুটোই লম্বালম্বি করে লাগানো। কাঁধ থেকে একটা কোমর অবধি। তার নীচে আরও এক খানা। রঙ চটা লাল রঙের সাড়ে চৌদ্দ লিটারের দুটো গ্যাস সিলিন্ডার। পিঠটা কুঁজো করে নেওয়াতে জায়গা হয়েছে একটু বেশি।   
এই দলের প্রধান ভদ্রলোকটি পকেট থেকে একটা সিগেরেটের বাক্স বার করে নিল। লাইটার দিয়ে এক খানা ধরিয়ে নিলআরেকটা ধরাল পাশের ভদ্রলোকের মুখে। ঠোঁট দুটোকে গোল করে নিয়ে অনেকটা ধোঁয়া আকাশের দিকে ছুঁড়তে ছুঁড়তে হে হে হে হে করে হেসে খানিক রসিকতার মুডে শুরু করল কথা। গলার কাঁপুনিটা কমে এসেছে। কথা বলার ভাবভঙ্গী দেখে মনে হল এতোক্ষণে বেশ একটা বলার মতো টপিক খুঁজে পেয়েছে।
-দেখ্‌ দেখ্‌ এরা কেমন। কিচ্ছু বলেনা। কি মজা দেখ এইখানে। আমাদের ওইখানে বাবুরা সিলিন্ডার ঘাড়ে নিয়ে ফ্ল্যাটের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে চান না। লিফ্‌টে চড়তে দিতে হবে তাদের। আরে এই কাজের মেয়ে গ্যাসআলা , এদের জন্য যেন প্রোমোটার লিফ্‌ট বানিয়ে দিয়েছে। সোসাইটি থেকে এদের লিফ্‌টে ওঠা নিষেধ। সিঁড়ি দিয়ে গ্যাস তুললেই বাবুরা এক্সট্রা পয়সা চায়। আর এইখানে দেখ এতো উঁচু উঁচু পাহাড়ি রাস্তায় কেমন ভার নিয়ে মেয়ে গুলো চুপচাপ উঠে যাচ্ছে
অন্য একটা মহিলার গলা শোনা গেল উত্তরে, আর আমাদের ওইখানে ঝি কে একটার জায়গায় দুটো এঁটো কড়াই বার করে দাও, দেখবে মুখ করে বাপের নাম ভুলিয়ে দেবে একদম। এইখান থেকে এক খানা কাজের মেয়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে এই এক খানা পিস নিয়ে গিয়ে দেখাতে ইচ্ছে করে ওদের। দেখ্‌ তোরা কেমন সুখে দিন কাটাস, আর এরা কেমন খেটে ইনকাম করে।
এদের কথার মাঝে কুলি মেয়েটি আরও একটু এগিয়ে গেছে ওদের ছেড়ে আস্তাবলের পাশ দিয়ে। ওর পিঠে ঝুলে থাকা ট্রলির চাকাগুলো হাওয়ায় ঘুরে যাচ্ছে শূন্যে। ও এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। 
এই দলটা আগামী তিন দিন এই দার্জিলিং পাহাড়ে থাকবে। বদ্ধ গাড়িতে গান চালিয়ে জঙ্গল পাহাড়ে ঘুরবে। সাইট সিইং করবে। দার্জিলিং নোংরা না পরিস্কার! হোটেলের চালগুলো মোটা না সরু! ডাকলেই রুমে চা পাওয়া যায় কিনা, চা গরম নাকি ঠান্ডা ! হোটেল বয় টিপস চায় নাকি এমনি এমনি ভালো সার্ভিস দেয়! এসব নিয়ে অনেক বিচার বিশ্লেষণ চলবেবিচার শেষে সিদ্ধান্ত শোনাবে।
ওই ভানু ভবন থেকে এই জাকির হোসেন রোডের মুখের হোটেল অবধি কয়েক মিটার পথে এদের বিচার সভা শুরু হয়ে গেছে।  চল্লিশ পঞ্চাশ কেজির ভার বহনকারী মেয়েদের বিচারক এখন এরা। বিচারকেরা  জ্যাকেট মাফলার  হাত মোজা পা মোজা ড্রয়ার হনুমান টুপি’র ভেতর থেকে বিচারবাণী শুনিয়ে যাচ্ছে এই পাহাড়বাসী ,যাদের সার্ভিস কয়েক মিনিট্ ,কয়েক ঘণ্টা্‌ ,কয়েক দিনের জন্য এদের দরকার- তাদের বিচার করছে। যাদের সার্ভিস দরকার নেই তাদেরও বিচারকর্তা এরা। সাথে সমতলের ওই মাসমায়না করা বখশিস দেওয়া মানুষ গুলোরও। এদের সবার ভালো মন্দ সুখ দুঃখ ঠিক বেঠিক সব কিছুর বিচার করার ভার নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে।

দার্জিলিংএ প্রতিদিন সকালে বিকেলে এরকম কত কত ট্যুরিস্ট আসবে। দু তিন দিন বেড়াবে ।বিচার করবে ।সিদ্ধান্ত দেবে। টিপ্‌স দেবে ।ঠকিয়ে দেবে কাঞ্চন জঙ্ঘার সামনের এই পাহাড়বাসীকে। পিছনে সুউচ্চ ঝলমল করা আকাশ ছোঁয়া কাঞ্চনজঙ্ঘা নিজেকে হাট করে তুলে ধরবে ট্যুরিস্টদের দিকে  আর ওই ওদের থু থু ছিটে ছিটে পড়বে সমতল থেকে আসা এই মানুষগুলোর দিকে।  



বাঙালি হৃদয় ও কাঁটাতার
প্রদীপ দে
 
আমাদের দেশ ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছিল ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ই আগস্ট।বহু মানুষের রক্ত,ঘাম,জীবনের বিনিময়ে পরাধীনতার গ্লানিমুক্ত হয়েছিল আমাদের মাতৃভূমি।
দীর্ঘ লড়াই সংগ্রাম, ত্যাগ তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে জন্মভূমি ঔপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খল মুক্ত হয়েছিল।ভারতবর্ষের মানচিত্র বদলে গিয়েছিল।দ্বিজাতি তত্ত্বের প্রয়োগে স্বদেশের বুকে একটি 
গভীর ক্ষত এঁকে দিয়েছিল শাসক ইংরেজ।
অনেক দেশনেতার মনোবাসনা পূর্ন হলেও
যে দগদগে ঘা বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের দরবারে নানা প্রশ্নের, সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।আর দেশবাসী আলোড়িত হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম ভূখন্ডের অভ্যন্তরে দিনাতিপাত করে।সংযুক্ত বাংলা বিচ্ছিন্ন হয়েছে।পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেছিল পূর্ব পাকিস্তান।ভাষা, সংস্কৃতি এক হওয়া সত্ত্বেও বাঙালির সামনে কাঁটাতারের বেড়া বিভেদ গড়ে দিয়েছে। উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে মন সায় দেয়নি বাঙালির।মাতৃভাষা বাংলাকে কেন্দ্র করে লড়াই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে জন্ম হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের।কাঁটাতারের ব্যবধান ঘোচেনি।এপার বাংলা ওপার বাংলা সাংস্কৃতিক ভাব বিনিময়ে,বাণিজ্যিক লেনদেনে,হৃদয়ের বার্তা আদান প্রদানের মধ্য দিয়ে মিলেমিশে আছে।পারস্পরিক সাহায্য সহযোগিতায় মানসিক দূরত্ব হয়তো নেই।তবু শাসকের রাজনৈতিক স্বার্থ, ভোটকেন্দ্রিক উন্নাসিকতা অনেক সময়েই দুই বাংলাভাষী 
এলাকায়, আত্মার আত্মীয়দের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।ধর্মীয় উগ্রতা,
সাম্প্রদায়িক উসকানি দু দেশের জনগণকে
সভ্যতা বিমুখ জাতি হিসাবে দর্পনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে অনেকবার।একে অপরের দিকে আড়চোখে দেখেছি, জীবন জীবিকার লড়াইয়ের পরিবর্তে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে মনোনিবেশ করেছি। ভেদবুদ্ধির কারবারীদের পাতা ফাঁদে ধরা দিয়েছি অবলীলায়।সেইসব শক্তি সমর্থ হয়েছে মানুষের বিরুদ্ধে মানুষকে দাঁড় করাতে,অস্ত্র হাতে তুলে নিতে প্ররোচনা জুগিয়েছে।মনের ভেতর  আদিম প্রবৃত্তির সুপ্তিকে জাগিয়ে তুলেছে নানা কায়দায়।কাঁটাতারের দুদিকেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুর মনের ভেতর আতঙ্ক ঢোকাতে পেরেছে মানুষরূপী হিংস্র হায়েনার দল।

ভারতবর্ষ মিশ্র সংস্কৃতির দেশ।নানা ভাষা ধর্ম মত খাদ্যাভ্যাস পোশাকে 'বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য'ই ভারতের আপামর জনগণের কাঙ্ক্ষিত। দেশ পরিচালনায় আমাদের সংবিধান এ সেই মনোভাবের প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়।নানা আলাপ আলোচনা, অধ্যয়ন, উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে 
আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধানকে ভারতবাসীর মর্যাদার, গৌরবের চর্যা হিসাবে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে চেয়েছি।আমাদের দেশের পররাষ্ট্র নীতি,কূটনৈতিক অবস্থানকে বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশ সম্মানিত করেছে,দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর বিপদে আপদে,কঠিন দুঃসময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।বিভিন্ন সময়ে সেই ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করেছে ভোটে জেতা
সংখ্যার গর্বে গর্বিত রাজনৈতিক দল।সমস্ত যুক্তি বিবেচনা বাদ রেখে,দেশের বৃহৎ সমস্যার সমাধানে বিরত থেকে মনগড়া কাল্পনিক চিন্তাধারায় আচ্ছন্ন রাখতে চেয়েছে সাধারণ নিম্নবিত্ত মধ্যবিত্ত মানুষকে।ধর্ম,জাতপাতের নামে,ভাষার নামে বিভেদের প্রাচীর গড়ে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ঐক্য বিনষ্ট করতে চেয়েছে।ধনী দরিদ্রের ব্যবধান বেড়েছে বছরের পর বছর।স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর সাত দশক কেটে গেলেও দুবেলা দুমুঠো অন্ন, লজ্জা নিবারনের পোশাক,মাথার ওপরে ছাদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি বৃহত্তম অংশের মানুষের।দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করে এক বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠী।রোগাক্রান্ত মানুষের ঠিকঠাক চিকিৎসা মেলে না।নিরক্ষরতার অভিশাপ মুক্ত হয়নি দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ।মানব উন্নয়ন সূচকে পিছিয়ে পড়া চোখে আঙুল দিয়ে যখন দেখিয়ে দিচ্ছে ভালো নেই দেশবাসী,মিথ্যার বেসাতি হচ্ছে বিজ্ঞাপনে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির ঘুণপোকা, ফানুস উড়ছে ভাষণে ঠিক তখনি আবার আসছে নতুন নতুন কৌশল, মানুষকে বোকা বানানোর, দেশবাসীকে অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবিয়ে রাখার।সমস্যার সমাধানে বলা হচ্ছে, বে-নাগরিক কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে দেশের অর্থনীতি।অথচ বিগত সেনসাস রিপোর্টগুলো তার অকাট্য প্রমাণ দিতে পারছে না।তাই ভাগ করার ষড়যন্ত্র।ভাইয়ে ভাইয়ে লড়িয়ে দেওয়ার উদগ্র বাসনা।'উইচ হান্টিং'এর নামে অস্থিরতা তৈরি করে নজর ঘোরানোর খেলা,সময়ের বৈতরণী বেয়ে,কুর্শি দখলে রাখার মতলব এঁটে সাধারণ মানুষকে আরো কোনঠাসা করার মরিয়া প্রয়াস।

সারা দেশের মত বাংলার মানুষ ও বিপদে।ভিটে মাটি ছেড়ে আসার ছেড়ে যাওয়ার যন্ত্রনা,দুঃসহ বেদনা অতীত স্মৃতিকে উস্কে দিয়েছে।উদ্বাস্তু কলোনির দীর্ঘশ্বাস, ডিটেনশন ক্যাম্পের মর্মভেদী কান্নার রোলে ভরিয়ে তোলার নোংরা খেলা শুরু হয়েছে।দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক বানানোর অপচেষ্টায় বেরিয়ে পড়ছে কোনো গোষ্ঠীর গোপন এজেন্ডা।দীর্ঘদিন এদেশের জল হাওয়া আলোয় স্বপ্নের জাল বুনে, কাঁটাতার পেরিয়ে ছিন্নমূল হওয়ার আতঙ্ক তাই মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে।এ লড়াই তাই অন্যান্য লড়াইয়ের থেকে মাত্রাগত দিক থেকে অনন্য।শুভ বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ তাই লড়াইয়ের ময়দানে।দেশভক্তির নমুনা আছে তার হাতের কিনাঙ্কে,পায়ের মোটা চামড়ায় ফোস্কা ফেলে
ফসলের মাঠকে শস্য শ্যামলা ভূমিতে রূপান্তরিত করায়, কারখানায় নিত্য ব্যবহার্য জিনিস উপহার দেওয়ার মারনখেলায়।পৃথিবীর ইতিহাসে খারাপ সময় এসেছে , সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ তার বিবেক বুদ্ধি চেতনা দিয়ে অন্ধকারের বুক থেকে ছিনিয়ে এনেছে রক্তিম সকাল।মাথার ওপরে মানবতার পতাকা তুলেছে।উগ্র প্রদেশিকতার বাতাসে নয়,সংকীর্ণতার মলিন প্রবাহে নয়,সেই পতাকা উড়েছে মিলিত শক্তির মহামিলনময় নির্মল বাতাসে।পুষ্পবৃষ্টির মতো দেশ গড়ার স্লোগানে স্লোগানে ভরে উঠেছে জন্মভূমি।হৃদয়ের বন্ধনে আবদ্ধ যে বাঙালি কাঁটাতারের বাঁধনে আটকে
রাখা যাবে কীভাবে? একই সূর্যের আলোয় একই উঠোন আলোকিত হলে, আলো বা উঠোন কী করে পৃথক করব?
'স্বপ্ন দিয়ে তৈরি স্মৃতি দিয়ে ঘেরা' দেশের দেশবাসীর ঘুম ভাঙে একই পাখির ডাকে।কীভাবে রুদ্ধ করব তার কন্ঠস্বর?'হেথায় আর্য অনার্য শক হুন পাঠান মোগল যে মহামানবের সাগরতীরে এক দেহে লীন হয়ে গেছে' সেখানে কাঁটাতার একটা সময়ের স্মারক, একটা বেদনাদায়ক স্মৃতি,তার গায়ে লেগে আছে রক্তের দাগ;তার এপার ওপার থাকবে 
আর অপারে খেলা করবে সৌভ্রাতৃত্বের মৃগকস্তূরী।বিবেকানন্দ, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন, প্রফুল্ল চাকী, বিনয় বাদল দীনেশ এর বাংলায়
কোনো বিভেদের ঘোলাজলে নয়, অন্তরের স্ফটিক স্বচ্ছ হ্রদে অবগাহন করবে 'সবার উপরে মানুষ সত্য' বাণী বাহক আপামর বাঙালি; গঙ্গা পদ্মা অববাহিকায় ফুটবে সূর্যমুখী।

 

গল্প

 

প্রতিবাদ 

সঞ্জয় কর্মকার 

বাউরিয়া গ্রামে একটা ষোলো বছরের মেয়ে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। গতকাল রাতে কোচিং সেন্টার থেকে ফেরার পথে অন্ধকার নির্জন রাস্তায় একা পেয়ে কারা যেন...

 না। দুর্বৃত্তরা এখনো ধরা পড়েনি। বাউরিয়া গ্রামের লোকজন পুলিশের গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে দফায় দফায়। রাজ্যের মিডিয়াও এই গণধর্ষণকাণ্ড নিয়ে কিছুটা সোচ্চার। বাউরিয়া গ্রাম-পঞ্চায়েত প্রধান তরুণ মন্ডল ধর্ষিতা কিশোরীর বাড়িতে এসে রীতিমতো হুঙ্কার ছেড়ে বললেন, "যারা এরকম নোংরা কাজ করেছে, তাদের একটাকেও ছাড়া হবে না। আমি বাউরিয়া থানার আইসি কে বলেছি, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে এই হারামিগুলোকে গ্রেফতার করতে হবে। ইশ! এরকম একটা ফুটফুটে মেয়েকে...

ধর্ষণের খবর চাউর হতেই ছুটে এসেছে কিশোরী মেয়েটার আত্মীয় বন্ধুরা। প্রতিবেশী ভোলানন্দ হাঁসদা মেয়েটার বাবা-মাকে সান্ত্বনা দিয়ে গেছে, "তোমরা কিছু চিন্তা করো না। যারা এত বড় একটা কাণ্ড ঘটালো, তাদের ফাঁসির দড়িতে ঝোলাব। আর তার জন্য সুপ্রিম কোর্টে যেতে হলে তাও যাব”।

ধর্ষিতা মেয়েটি এখন শহরের একটা হাসপাতালে ভর্তি। একটু আগে খবর এলো তার অবস্থা স্থিতিশীল। 

আকস্মিক একটা ছোট্ট ভিড় মেয়েটির বাড়ির উঠোনে। ঘটনাটার খবর শুনে কোচিং সেন্টারের শিক্ষক দিলীপ কর এসে বেশ উত্তেজিত স্বরে বলছেন, "অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করব আমরা। এভাবেই অনেক মেয়ের জীবন অকালে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অথচ পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার আড়ালেই থেকে যাচ্ছে এই অপরাধীরা"।

 “হ্যাঁ স্যার, আপনি একদম ঠিক বলেছেন। অনেক অপরাধীই এমন ঘৃণ্য কাজ করেও আড়ালে থেকে যাচ্ছে। অথচ তারা..."

অসমাপ্ত থেকে যাওয়া বাক্যটা শুনে দিলীপ কর ঝটিতি মাথা তুলে দেখলেন, সামনে  দাঁড়ানো মেয়েটা তাঁরই ছাত্রী। নাম মিতালী। প্রায় বছর দশেক আগে তাঁর কোচিং সেন্টারেই পড়তে যেত। এখন স্কুল শিক্ষিকা। রাগে ঘৃণায় মিতালীর চোখ থেকে যেন আগুন ঝরে পড়ছে। আর সেই আগুন ঝরা চোখের দিকে চোখ পড়তেই দিলীপ কর মুহূর্তে নামিয়ে নিলেন  নিজের মাথাটা। আশপাশের ভীড়টা এখন তাঁর  বেশ অসহ্য লাগছে।




বিপ্লব ও সেই কিশোরী মেয়েটি 

মনীষা শেখ 

 জনতার তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে ভেঙে পড়ল তুইলরি প্রাসাদের মূল ফটক।  এক নিমেষের মধ্যে জায়গাটা হয়ে উঠল ভয়াবহ। সযত্নে কেয়ারি করা  ফুলের বাগান তছনছ করে উন্মাদ জনতা  ছড়িয়ে পড়ল প্রাসাদের আনাচে-কানাচে। প্রাসাদের সৌখিন জিনিসপত্র ভেঙেচুরে একসা করে তাদের স্বাধীনতা, তাদের প্রাপ্য যেন তারা আদায় করে নেবে এক্ষুনি। ফ্রান্সের রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষুদ্ধ জনতা প্রতিদিনই কোনো না কোনো সম্ভ্রান্ত অভিজাত বা সামন্তের প্রাসাদে হয় আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে, নয় ভেঙ্গে চুরে তছনছ করছে।

তুইলরি প্রাসাদের এক নিভৃত কক্ষে বছর ষোলোর এলিজা তার মায়ের কথায় কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। প্রাসাদ আক্রান্ত। জনগণের মুহুর্মুহু হুংকারে কেঁপে উঠছে প্রাসাদের আনাচ-কানাচ। হাতে সময় খুবই অল্প। এখনই স্থির করতে হবে পরের ভবিতব্য। তার মা নিয়ে এসেছেন এক অতি তীব্র হলাহল। শরীরে প্রবেশ করা মাত্র দু চোখে নেমে আসবে স্বপ্নের অন্ধকার। কিন্তু কিশোরী এলিজা কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। ভার্সাই থেকে জাঁ পলের আজকে আসার কথা। তার পলের সঙ্গে কথা না বলে, দেখা না করে কিভাবে এই বিষ সে পান করবে?  প্রাসাদে ঢোকার মুখে যে বড় গোলাপ বাগিচা আছে তার ডান দিকের সরু পথ দিয়ে গেলে শ্বেতপাথরের চতুর্থ বেদিটার পাশে তাদের দেখা করার কথা। 

চারদিকে আর্তনাদ, কোলাহল তীব্র হয়ে উঠছে। বন্দুকের শব্দ, বারুদের ধোঁয়ায় ধুলোয় মনেই হচ্ছে না যে এখানে কত শান্তিতে তারা এত বছর কাটিয়েছে। এলিজার চোখ থেকে স্বপ্নের ঘোর কিছুতেই কাটতে চায় না। তার বছর-দশেকের ছোট বোন কিছুই না বুঝে মা'র পাশে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। তার হাতে ধরা রয়েছে তার প্রিয় পুতুল। "হে ঈশ্বর! সব আগের মতো করে দাও!" এলিজার প্রার্থনা শেষ হবার আগেই ভেঙ্গে পড়ল সভাকক্ষের প্রধান স্তম্ভ। মায়ের হাতের পাত্রের দিকে তাকায় এলিজা। ফ্রান্সের অভিজাত সম্প্রদায় এতদিন যে অত্যাচার চালিয়েছে সাঁকুলতদের ওপর, তার ফল ফলতে শুরু করেছে। পচে গিয়েছে ফ্রান্সের সমাজ।  কিন্তু সে, তার বোন, মা-  তারা তো কোন অন্যায় করেনি! এলিজার মায়ের হাত দুর্ভাবনায় থর থর করে কাঁপছে। নিজের জন্য নয়। তিনি জানেন উন্মাদ জনতা পশুদের থেকেও খারাপ। তাদের হাতে নিজের প্রাণপ্রিয় দুই সন্তানকে তিনি কিছুতেই ছেড়ে দিতে পারেন না। 

তাঁদের দাস-দাসীরা যে যেমন পেরেছে, পালিয়ে বেঁচেছে। কেউ কেউ যোগ দিয়েছে বিদ্রোহীদের দলে। রাজা লুই পরামর্শের জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন এলিজার পিতাকে। যাবার আগে তিনি নিজের স্ত্রীর হাতে তুলে দেন এই তীব্র হলাহল, যা পান করতে অস্বীকার করছে এলিজা। ওই! ভেঙে পড়ল আরও একটি কক্ষের দরজা! হুঙ্কার, আর্তনাদ আর কান্নার শব্দ ক্রমশ এগিয়ে আসছে। আর দেরি করা চলে না। আরও দেরি হলে...

দুই সন্তানের হাত ধরে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে চলেছেন এক মা। একটা উপায় এখনো আছে। যেতে হবে সভাকক্ষের একেবারে মাঝখানের একটি ঘরে। সেখানে আছে একটি গুপ্তকক্ষ। চারদিকে জ্বলছে আগুন। সশব্দে ফেটে যাচ্ছে আসবাবপত্র। হিংস্রতার হাহা উল্লাস ধ্বনিতে কেঁপে উঠছে বাতাস।

 সেই ভীড়ে জনতার চোখ বাঁচিয়ে মুখ ঢেকে ছুটে চলছে তিনটি নারী। লক্ষ্য সভাকক্ষের দেওয়ালে টাঙানো একটি অপূর্ব ছবির প্যানেল। তাঁরা প্রায় পৌঁছে গেছেন, এমন সময় তাঁদের দেখে ফেলল কয়েকজন বিদ্রোহী। প্রাণপণ চেষ্টায় শত্রুর হাত থেকে মুক্তির আশায় গোপন হাতল ধরে টান দিতেই সরসর করে সরে গেল প্যানেলটি। ভেতরে কয়েকফুট দূরে একটি পাথরের চৌকো বাক্স। তার মধ্যে ছোট মেয়েকে ছুঁড়ে ফেলে নিজেও ঢুকে পড়লেন এলিজার মা। এলিজার হাত ধরে  তাকেও জোর করে ঢোকানোর চেষ্টা করলেন।  কিন্তু হায়! এলিজার অন্য হাতটি উন্মত্ত লোকগুলো ধরে ফেলল। এক সেকেন্ড মেয়ের সাদা হয়ে যাওয়া মুখের দিকে তাকালেন এলিজার মা। তারপর প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে টানলেন হাতলটা। ঘর্ঘর শব্দে বন্ধ হয়ে গেল পাথরের দেয়াল। এলিজার কাটা হাতখানা বাঁচতে চাওয়ার অম্লান প্রতীক হয়ে দেওয়ালে ঝুলতে থাকল, কাঁপতে থাকলো তিরতির  করে।


ছুট


অতনু টিকাইৎ


শহর, মফস্বল, কলকাতা ফোর-জি স্পিডে ছুটছে যখন, শ্যামদা তার নিজের খেয়ালেই। সেম রুটিন ধরে হাঁটতে থাকে, যেভাবে সাতটা বছর। ভোর ভোর স্নান সেরে দোকান খোলে। তারপর সাইকেলে প্যাডেল, যায় বড়হাট। বাজার সেরে এসে উনুন জ্বেলে সেই যে চা বানানো শুরু হলো, শেষ রাত আটটায়। আমাদের বন্ধুদের এ শহরে একমাত্র আড্ডাস্থল। ল্যাদ খেতেই জড়ো হই। এক-দু কাপ চা'য়ে গোটা বেলা কভার। দোকান বেঞ্চিটার ওপর মায়া পড়ে গেছে। সম্পর্কটা তো কম দিনের হলোনা!



তীর্থ মজার সুরে প্রায় বলে, 'আমাদের ছেলেপুলেরাও শ্যামদার দোকানে এভাবেই আসবে।'

শুনে শ্যামদা আনন্দ পায়। মুচকি হাসে। সেদিন হাসলো না। চা বানাচ্ছিল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললো, 'তোমরা তন্দুরি চা খেলে?'



সুভাষ জানালো একটু এগিয়ে একটা নতুন দোকান হয়েছে। ফাস্ট ফুড, সাথে তন্দুরি চা। চা টা শুনছি ভালো করছে।  তবে প্রথমেই টাকা ধরিয়ে টোকেন কেটে খেতে হয়। হেব্বি ভীড় হচ্ছে। 



বুঝলাম শ্যামদা ব্যবসায় ক্ষতির ভয় দেখছে।



অনেক পরে। ঠিক মনে নেই। কলকাতা থাকাকালীন একদিন শুনতে পেলাম শ্যামদা দোকানটা বন্ধ করে দিয়েছে। একটা টোটো ভাড়াতে চালায়।



সেই রাতেই স্বপ্নে শ্যামদাকে দেখলাম আমি। দেখলাম শ্যামদাও শহর, মফস্বল, কলকাতাদের দলে নাম লিখিয়ে ছুটছে। আমি, তীর্থ, সুভাষ দাঁড়িয়ে আছি। কোথাও নিশ্চিন্তে দু'দন্ড বসার জায়গা পাচ্ছি না।


আমি মনের মতো পাগল হলাম না

পৃথ্বী ব্যানার্জী 

আমার হস্তরেখায় না কি আছে পঞ্চাশ হতে না হতেই আমি পুরোদস্তুর মানে বদ্ধপাগল হয়ে যাবো।
কোষ্ঠীতে তো আরো এক কাঠা ছাড়িয়ে গিয়ে লিখেছে চল্লিশ হতে না হতেই পাগলামি শুরু হবে, চুয়াল্লিশে গিয়ে এলাকার নামকরা পাগল হবোই হবো। চুয়াল্লিশ কেন, পঞ্চাশও তো সেই কবেই ধূসর অতীত হয়ে গেছে। আমি কি ভয়ংকর পাগল ?
এ ব্যাপারে আমার ঘরওয়ালীর মতামতের এভিডেন্স হিসাবে একটা আলাদা দাম আছে। কেন না তিনিই আমাকে সবচেয়ে কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে দেখেছেন। তার চাঁচাছোলা মন্তব্য প্রায়ই আমার "কানের ভিতর দিয়া" একেবারে মরমে প্রবেশ করে। খাস ঘটি, হালতুতে দশ পুরুষের বাস। বলেন --" যার হাতে, কোষ্ঠীতে এত পষ্ট করে নেকা আছে চল্লিশ হতে না হতেই পাগল হবে , তাকে যাই বলো বাপু বাড়ির থেকে বিয়ে দেওয়া ঠিক হয় নি কো। আর তোমারো বলিহারি যাই বাপু !  বত্রিশ পাটি দাঁত বার করে নাফকে নাফকে(লাফাতে লাফাতে ) গিয়ে বিয়ে করে এলে! সত্যি কতা কইতে এই বান্দি ভয় পায় না বাপু। বিয়ের আসরে তোমাকে দেখেই আমার মনে কেমন 'কু' ডেকেচিলো। কেমনতরো পাগল পাগল ভাব।চশমার ঘোল্লা ঘোল্লা কাচ। তার মধ্য দিয়ে জুলজুল করে আদখেলার মতো তাকাচ্চে!  গোঁপটাতেও (গোঁফটাতেও) ক্যামন পাগল পাগল ছাট। একদিক বড় একদিক ছোট। মুখটা কেমন ব্যাঁকা!
হায় হায় এতো শিবপূজো করে শেষে এই পাগল লোকটা জুটলো আমার "প্রাণেশ্বর" হয়ে"!
আমি মরীয়া হয়ে বলি," তবে ফুলশয্যার রাতে আমি যখন তোমার হাতে হাতি,ঘোড়া বিস্কুট আর একটা লেবেনচুষ দিয়ে বললাম,"খাও সোনা" তুমি আমার গলা জড়িয়ে কেন বলেছিলে,"তুমি না আমার একমাত্র বর! এই আমার মতো গলা জড়িয়ে ধরে খাইয়ে দাও নক্ষীটি (লক্ষ্মীটি) ।"
ঘরওয়ালী গালে হাত দিয়ে মুখব্যাদন করে বলেন,"ওমা! আমার কি হবে গা? কবের সেই চল্লিশ বচ্ছর হতে চললো সামান্য দুটো বাচ্চাদের হাতি, ঘোড়া  না কি ছাতা বিস্কুট আর ঐ লেবেনচুষ সেই বাজারে  এক আনা মানে চার পয়সাও দাম নয় কো! আজও খোটা দেয়! সাধে কি সব নোকে বলে 'এই মুকুজ্জে (মুখার্জী) বাবুটা পাগল সেজে থাকে। আসলে সেয়ানা মাল। সেয়ানা পাগল'। বলি ও ভালো মানুষের পো! তুমি পাগল টাগল কিচু (কিছু) নয় আসলে। সেয়ানা আর ঢ্যামনা! ওগো আমার কি অবস্তা হলো গো এই ঢ্যামনা মিনসেটার জন্য!!!
শুনে রাকো আমি হালতুর মেয়ে।এসব ফালতু ঢ্যামনামি পচন্দ করি না কো। দোবো একদিন বিষদাঁত ভেঙে।" 
আমি বলতে পারতাম 'ঢ্যামনা মানে তো নির্বিষ বিরাট সাপ, যারা শুধু ফোঁসফোঁস করে। তার আবার বিষ দাঁত কোথায় পেলে? বলিনি ---হালতুর মেয়েকে আবার ঘাটানো!!!
    
যেতে দিন। ঘরওয়ালিদের মানে গৃহিণীদের কথা, বিশেষ করে বাঙালী গৃহিণীদের কথা যত কম বলা যায় ততই শান্তি। সারা পৃথিবী জুড়েই বাঙালী গৃহিণীরা কুখ্যাত স্বামীর বিরুদ্ধে পরস্পর বিরোধী কথা বার্তা বলার জন্য। এই বললেন 'আমার শিবের মতো বর। সাদা মনের মানুষ। মাটির মানুষও বলতে পারো', তো পর মুহূর্তেই বলবেন,'এই গোলমেলে পেঁচুরে লোকটা আমার হাড়মাস কালি করে দিলে গো!' 
 যাই হোক। আমার পাগলামি হোক,সেয়ানাগিরি হোক কি ঢ্যামনামিই হো্‌ সে সবের  সৎ আর পূর্ণ বিবরণ লিখে আপনাদের  সুযোগ সুবিধামতো পড়াবো। কথা দিচ্ছি। যাতে আপনারাই আমার ঠিক ক্লাসটা বুঝতে পারেন।

এযাত্রা বরং এক পাগলী আর দুই পাগলের সঙ্গে আমার মোকাবিলার ঘটনা আপনাদের শুনাই।
অনেক দিন আগের কথা। এ ঘটনা আমার মায়ের মুখ থেকে শোনা।আমার বয়স তিন, চার মাস। খুব রোগা।শীতকাল। মা আমার গোটা শরীরে একদম চুপচুপে করে তেল মাখিয়ে উঠোনের রোদে ফেলে রেখেছেন। তখন দমদমে অনেক বড়ো বড়ো পাগল মায় পাগলীও স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াতো। (এখন যেমন অবিশ্বাস্য হারে আসল আর বড়ো পাগলদের সংখ্যা কমেছে তেমনি বেড়েছে আসল আর বড়ো ছাগলের মানে রামছাগলের সংখ্যা) ।
 এমনি এক পাগলীর মাথায় জটা চোখে আগুনের ভাটা। আমাকে কোলে তুলে নিয়ে সিধা বাড়ির কাছেই পুকুর ঘাটে। মা আওয়াজ শুনে বেরিয়ে এসেছেন,"এই পাগলী! আমার বাচ্চা দে। শিগগির ফেরত দে"। কান্না,অনুনয়বিনয় ভয় দেখানো কিছুতেই টলে না সে পাগলী। মুখে খিলখিল হাসি। আমাকে দু হাতে ধরে মাথার উপর ছুঁড়ে  দিচ্ছে, আবার লুফে নিচ্ছে।
একবার পাগলীর হাত থেকে ফসকে গেলে ইট সুরকির বাঁধানো ঘাটলায় পড়ে অতটুকু বাচ্চার মাথা ফেটে চৌচির হয়ে এমনিই মরে যাবে। ইতিমধ্যে মা দৌড়াতে দৌড়াতে এসে পাগলীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে পাগলীর হাত থেকে আমাকে কেড়ে নেওয়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে চলেছেন। পারবেন কেন? পাগলদের গায়ে একস্ট্রা জোর থাকে।
এতক্ষণে পাগলী বাঙাল ভাষায় বলে উঠলো," আমার থন কাইড়া লইতে আহস্! এই বাচ্চা কি ত'র? অর কপাল থনও জুতি বাইরায় (কপাল থেকে জ্যোতি বেরোয়) যেমন আমগো সব বড়ো বড়ো পাগলগো বাইরায়। অয় বড় হইলে খুব বড়ো পাগল হইবো। অয় তাই ত'র না আমগো।
তয় পাগলের জীবন বড়ো কষ্টের রে। আমি চাই না অয় এই কষ্ট পাউক। অরে অখন আমি এই পুকুরে ডুবাইয়া দিম। তয় মইরা বাঁচবো।" বলে পাগলী আমাকে নিয়ে জলে নামতে গেছে। মা প্রাণপণ চীৎকার করে উঠলেন। হঠাৎ পাগলীর কি মনে হলো। আমাকে মাথার উপর ছুড়ে দিয়ে আর একবার লুফে নিয়ে  বললো," এ দেহি এক্কারে পক্ষীর পালকের  নাহান(মতো) হালকা। জলে তো এ ডোফবেই না, ভাসফে। ভাইস্যা থাকফে(জলে এ ডুববে না।ভেসে থাকবে)। ল পোলা ফ্যারত ল। তয় অরে ভালো কইরা খাওয়াই রোদ মাখাইয়া মুডাসুডা(মোটাসোটা)করন লাগবো, যাতে জলে ফ্যালাইলে ডুইব্যা যায়। আমি আবার আসুম অরে নিয়া জলে ডুবাইয়া মারণের জন্য।" 
এই বলে মায়ের কাছে আমাকে দিয়ে সেই যে পাগলী হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলো আর কখনো তাকে দেখা যায় নি।
আমার সঙ্গে দ্বিতীয় মনে রাখার মতো বড়ো পাগলের দেখা যখন আমার বয়স বছর তেইশ। অপুষ্ট চেহারা ভাঙা গাল ঢাকার জন্য ঘন দাড়ি।দাড়ি রেখে কবি কবি ভাব আনার চেষ্টাও আছে। যদি কোনো' ডাগর আখি' ভুল করেও ক্ষনেকের তরেও 'আমার পানে' ফেরে।
 তখনকার বাগুইআটির সাথে আজকের বাগুইআটির কোনো মিলই নেই। মাঠ ঘাট প্রান্তর চাষের জমি। দক্ষিণপাড়া মোড়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছি। হঠাৎ দেখি খাল পার থেকে ছুটে আসছে কে একজন। হাতের লাঠিকে একমুখ সরু করে কিছুটা বল্লমের মত বাগিয়েছে। 
 প্রবল বেগে ছুটে আসছে আমারই দিকে। বছর পঁচিশেক বয়স, মাথায় জটা, মুখে বিরাট দাড়ি। কাউকে বলতে হবে না। এ এক বিরাট পাগল এবং এর  টার্গেট আমিই। লাঠি বাগিয়ে প্রায় আমার গায়ের উপর এসে পড়েছে। মুখে রণহুঙ্কার,"পাইছি! পাইছি!" 
দেরী হয়ে গেছে বুঝেও আমি প্রাণপণে ছুটছি। মাঠ জঙ্গল প্রান্তর ভেঙে ছুটছি। পিছনে প্রায় ঘাড়ের উপর মুখ সরু মুখ মোটা লাঠি বাগিয়ে ধরা বিরাট এক পাগল। দম আমার প্রায় শেষ। সামনে মৈত্রদের মাঠ পেরোতে পারলেই বাড়ির গলি পেয়ে যাবো। হঠাৎ রাস্তা আটকে এক বিরাট দেওয়াল। আরে মৈত্রদের মাঠের শেষে যে বিরাট দেওয়াল উঠে গেছে, আমি উত্তেজনায় বেমালুম ভুলে গেছি। আর উপায় নেই। হাত তুলে দাঁড়িয়ে গেছি। হঠাৎ পাগলটা লাঠিটা বা হাতে নিয়ে ডান হাত দিয়ে আমায় আলতো করে ছুঁয়ে বললো,"কি ভেবেছিলি? তোকে আমি দৌড়ে ছুঁতে পারবো না? তুই আমার থেকে বড়ো পাগল? নে এবার আমায় দৌড়ে ছোঁ তো!" বলেই উলটো দিকে ছুট লাগালো। মুখে রণহুঙ্কার "হাই মারি! হাই মারি।" ইস্ আগে যদি জানতাম শুধু আমাকে ছোঁয়ার জন্য পাগলের আমাকে এই ভয়ংকর তাড়া!  
পাছে ভাবে আমি খেলছি না তাই আমিও একটুক্ষণ "ধর! ধর" করে তার পিছনে তাড়া করে ঘুর পথে বাড়ি ঢুকে পড়লাম।
মজার কথা এরপরও এই পাগলটির সাথে আমার বার কয়েক রাস্তায় দেখা হয়েছে। আমি ভয় পেলেও সে আমাকে চিনতেও পারে নি।
মাঝের এই এতোগুলি বছরে বিস্তর ছোটখাটো পাগলের সাথে মুলাকাত হলেও মনে রেখাপাত করার মতো মস্ত পাগলের দেখা পেলাম এই মাত্র কদিন আগে মানে এই তিরিশে জুলাই।
আমি দমদম পার্ক থেকে হেঁটে হেঁটে দক্ষিণপাড়া আসছি। ভরদুপুর এক ফোটা বৃষ্টি নেই। অমন জনবহুল রাস্তা শুনশান। হঠাৎ সামনে দেখি প্রকাণ্ড চেহারার এক ভয়াবহ দর্শন পাগল। পরণে শতচ্ছিন্ন নোংরা পোষাক, মাথায় নোংরা জটা, নোংরা দাড়িগোঁফ। ডান হাতে ফুট চারেকের একটা শক্ত বাঁশ। কয়েক হাত যাচ্ছে আর রাস্তায় বাড়ি মেরে কান পেতে কী শুনছে। আমি ভয় পেয়ে গিয়ে ভাবছি , আবার আমার মাথায় ডাঙ্ মেরে বসবে না তো! আমি স্তম্ভিত হয়ে দেখছি। এই সময় আমি পাগলের চোখে পড়ে গেলাম। সামনে এসে খুব মোলায়েম মিষ্টি স্বরে বললো," কি ভাবছিস? আমি কি করছি? এই পাগল জীবনে কত কষ্ট বল! লোকে মানুষ ভাবে না পাগল ভাবে। তাই আমি আসল পাগল দেখতে পেলেই গলির মধ্যে নিয়ে গিয়ে মাথায় ডাঙ্ মেরে মেরে ফেলি। তারপর গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে মাটির নীচে কবর দিয়ে দি। 
তা ভাবিস না আমি খুব স্বার্থপর। এই যে দেখছিস রাস্তায় বাঁশের বাড়ি মারতে মারতে যাচ্ছি,আসলে ওরা কে কেমন আছে খবরটা নিচ্ছি। আমার বাঁশের বাড়ির আওয়াজ পেলেই ওরা ঘুমিয়ে না পড়লে সবাইই  উত্তর দেয়। কেউ বলে ," মরে গিয়ে বেঁচে গেছি", কেউ বলে," উপরে এক ফোঁটা বৃষ্টি হোলো না।  পচা গরমে ভেপসে মরছি"। এই তো খানিকক্ষণ আগে এক বড় পাগল খুব কান্নাকাটি করছিল, গতকাল রাতে নেংটি ইঁদুর তার দু কানই অর্ধেকটা করে কেটে নিয়ে গেছে। আমি তাকে বোঝালাম,"যখন বেঁচে ছিলি দেখিস নি। এই উপরে যেসব লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের অনেকেরই পুরোপুরি দু কা্নই সেই কবে কাটা গ্যাছে। তারা তো এতটুকু না ঘাবড়ে ঐ কাটা দু কানকেই জোড়াতালি দিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভালো করে ঘুমো তো। কাটা কান আপসেই বেড়ে ঠিক হয়ে যাবে।"
এই এইসব আর কি!
তারপর আমাকে তীব্র দৃষ্টিতে নজর করে বললো," তোকে আমি দেখে নিয়েছি। একদম আমার মনের মতোন পাগল। খাটি চিজ্। আসলি পাগল। চল্ তোকেও এই পাগলের জীবন থেকে মূক্তি দি"
তারপর আমার হাত ধরে টানতে টানতে গলির গলি তস্য গলিতে নিয়ে গেল। জায়গাটা জনমানবহীন। কেমন অচেনাও। এদিকে আমার মুখ দিয়ে একটা আওয়াজও বেরোচ্ছে না। পালাবো কি নিজের থেকে এক পাও চলতে পারছি না।
 খটখটে রোদ। প্রখর দুপুরের আলো। পাগল আমার মাথার উপর বাঁশ তুলেছে মারবে বলে। হঠাৎ কি মনে হয়েছে একটু থমকে দাঁড়ালো। আমার মাথার উপর থেকে বাঁশ নামিয়ে বললো,
"খুব সিরিয়াস কাজ বুঝলি! যদি ভুলচুক হয়ে যায়! মানে আসল পাগল না, সেয়ানা পাগল কি ঢ্যামনা। অথচ মেরে দিলাম!"
এই বলে ছেঁড়া নোংরা পকেট থেকে একটা ঝকমকে গ্যাস লাইটার বার করে  জ্বালিয়ে দুপুরের খটখটে রোদে শিখাটা আমার মুখের উপর ধরলো। একটু পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,"না রে! তোর হবে না। তোর মধ্যে আমার 'মনের মতো পাগল পেলাম না।' তুই ডাহা ফেল--- সেয়ানা পাগলও না। একেবারেই ঢ্যামনা।"
 পাগলটা মন খারাপ করে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে ফেলে রেখে চলে গেল।
সেই দুপুর থেকেই আমার মনও ভারী খারাপ হয়ে আছে। 'আমি মনের মতো পাগল' হলাম না।

অনুবাদ সাহিত্য


চার্লস ল্যাম্ব

 

স্যামুয়েল টেইলর কোলেরিজকে লেখা চার্লস ল্যাম্বের চিঠি
শ্যামশ্রী রায় কর্মকার

চার্লস ল্যাম্ব ছিলেন উনিশ শতকের এক প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক ও প্রবন্ধকার। তাঁর লেখা " এসেজ অফ এলিয়া" আর   শিশুদের জন্য তাঁর সংকলন "টেলস ফ্রম শেকসপিয়ার" এর জন্য সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে আছেন। "টেলস ফ্রম শেকসপিয়ার" গ্রন্থটিতে তাঁর সহযোগিনী ছিলেন তাঁর দিদি মেরি ল্যাম্ব।

চার্লস ল্যাম্বের সঙ্গে ইংরাজি সাহিত্যের আরেক নক্ষত্র স্যামুয়েল টেইলর কোলেরিজের দেখা হয় স্কুলজীবনে, ক্রাইস্টস হসপিটালে। এই সাক্ষাৎ পরবর্তীকালে আজীবনব্যাপী এক প্রগাঢ় বন্ধুত্বে পরিণত হয়। ল্যাম্ব সেইসময় ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির লন্ডন শাখায়  ইস্ট ইণ্ডিয়া হাউসের ক্লার্ক হিসাবে যোগ দিয়েছেন । সাহিত্যজগতে ধীরে ধীরে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে। অন্যদিকে শিরোরোগের করাল ছায়া গ্রাস করে ফেলছে তাঁর পারিবারিক জীবন। মেরি সারাজীবন ধরে বারবার মানসিক রোগের শিকার হয়েছেন। ল্যাম্ব নিজেও একবার এই রোগের কবলে পড়েন। সুস্থতা লাভ করলেও সারা জীবন ধরেই রোগের পুনরাবৃত্তির আশংকা তাঁকে ঘিরে রেখেছিল।
যখন তিনি কোলেরিজকে এই চিঠি লিখলেন, তখন এক চূড়ান্ত ট্র‍্যাজেডি এসে ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে তাঁর পরিবারকে। মেরি ল্যাম্ব মানসিক অসুস্থতার এক চূড়ান্ত মুহূর্তে হত্যা করেছেন তাঁদের মাকে। দিদির প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসায় চার্লস এই হত্যার দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন।

২৭শে সেপ্টেম্বর, ১৭৯৬

প্রিয় বন্ধু,
             এতক্ষণে নিশ্চয় তুমি জেনে গেছ যে আমার পারিবারিক জীবনে কী বিপর্যয় ঘটে গেছে! হোয়াইট বা আমাদের অন্যান্য বন্ধুরা নিশ্চয় তোমাকে কিছু জানিয়েছে এ ব্যাপারে। তা নাহলেও খবরের কাগজ থেকে তো তুমি আভাস পেয়েই থাকবে। তাই সংক্ষেপেই বলি তোমাকে। আমার আদরের দিদি মেরি র মধ্যে একদিন খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। এতটাই, যে সে আমাদের মাকে হত্যা করে বসে। আমি শুধু ঘটনার পর তার হাত থেকে ছুরিখানা কেড়ে নেবার মত সময়টুকু পেয়েছি। ঈশ্বর আমার বুদ্ধি বিবাচনাবোধ অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। দৈনন্দিন সব কাজই ঠিকমতো করতে পারি। আমার বিচারবোধও যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য বলেই আমার বিশ্বাস। বাবাও এই ঘটনায় আঘাত পেয়েছেন। এখন বাবা আর মাসীর সেবার ভার আমার ওপরেই। "ব্লু কোট " স্কুলের মিস্টার নরিস খুবই সাহায্য করছেন। বন্ধু বলতে এখন আর অন্য কেউ নেই। ঈশ্বরকে অনেক ধন্যবাদ যে আমি এখনও সুস্থ স্বাভাবিক আছি। সব কর্তব্যই করতে পারব। যতটা পারো ধর্মমূলক চিঠি লিখো আমাকে। কিন্তু যা ঘটে গেছে, তার আর উল্লেখ করোনা। অতীত এখন আমার কাছে মৃত। আবেগ অনুভব করার চেয়ে কর্তব্য পালন আমার কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন। কবিতা নিয়ে আমাকে আর কিছু বোলোনা। অতীতের দম্ভের সমস্ত চিহ্নই আমি ধ্বংস করে ফেলেছি। তোমার এ ব্যাপারে যা মনে হয়, করতে পারো। তবে যদি আমার লেখা প্রকাশ করো, আমার নাম বা আদ্যাক্ষর ছাড়াই তা কোরো। আমার পূর্ণ সম্মতি রইলো। আর দয়া করে আমাকে কোন কপি পাঠিয়োনা, এই অনুরোধ রইলো।

তুমি যথেষ্ট বিচক্ষণ। আশা করি তোমার স্ত্রীকে এ বিষয়ে কিছু জানাবেনা। পরিবারের যত্ন নিও। আমার পরিবারের এখন যত্নের বড় প্রয়োজন, আর আমি অবশ্যই তা নিতে পারবো। দয়া করে আমার সাথে দেখা করতে এসো না। তুমি এলেও আমি দেখা করবো না। চিঠি লিখো। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যেন তোমার সঙ্গেসঙ্গে আমাদের সকলকেও করুণা করেন।

চার্লস