Saturday 9 January 2021

কী লিখলাম, কেন লিখলামঃ তুষারকান্তি রায় ,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 কী লিখলাম, কেন লিখলাম 

তীর্থংকর মল্লিনাথ: অতীত অনুসন্ধানের আর এক নাম: তুষারকান্তি রায় 


 

তীর্থংকর মল্লিনাথ / তুষারকান্তি রায়  / অভিযান পাবলিশার্স  / দাম – ২০০ টাকা

অতীতের সঙ্গে বর্তমানের আলাপের মধ্য দিয়েই উন্মোচিত হয় ভবিষ্যতের অনন্ত সম্ভাবনা । সম্ভবত সেই কারণেই গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য চিরকালই সমাজ ও ইতিহাসকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে । অতীতের স্বপ্ন – সময়যাত্রা কিংবা পুরাণ – ইতিহাস অথবা কিংবদন্তি থেকে উঠে আসা ঘটনা ও চরিত্রের মধ্য দিয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান কোনও এক মহা- ব্যক্তিত্ব । অভিযান পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত আমার ‘ তীর্থংকর মল্লিনাথ ’ আধুনিক অভিঞ্জতার চোখে দেখা প্রাচীন জীবনের অনালোকিত এক কিংবদন্তির বিস্মৃত ইতিহাস । আমার এই উপন্যসটি ( জৈন ধর্ম বিষয়ক প্রথম বাংলা উপন্যাস ) পাঠকের দরবারে হাজির করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ।

যদি কেউ প্রশ্ন করেন , ‘ তীর্থঙ্কর মল্লিনাথ ’ লেখার কারণ কী ? আমার উত্তর হবে , অনালোকিত  অতীত অনুসন্ধানের আর এক নাম ‘ তীর্থংকর মল্লিনাথ ’ । সকলেই জানেন , জৈনধর্মের প্রবর্তক মহাবীর এর পূর্বেও তেইশজন তীর্থংকর ছিলেন । যাঁদের হাত ধরে জৈন ধর্মমত গড়ে উঠেছে এবং প্রসারলাভ করেছে । একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে , গৌতমবুদ্ধ এবং মহাবীরজৈন প্রায় সমসাময়িক হলেও ধর্মবিস্তারে বৌদ্ধধর্ম গোটা বিশ্বে যতটা প্রসার লাভ করেছিলো জৈন ধর্মমত সেই জনপ্রিয়তা পায়নি । সম্ভবত পালনীয় কর্তব্য সম্পর্কে অতিরিক্ত সচেতনতা এবং রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাব এই দায়িত্ব পালন করেছে । যাই হোক , খৃস্টপূর্ব  তৃতীয় শতকেই অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বের কারণে ভদ্রবাহুর নেতৃত্বে দিগম্বর এবং স্থূলবাহুর  নেতৃত্বে শ্বেতাম্বর নামে দুটি শাখায় জৈন ধর্মাবলম্বীদের বিভাজিত হতে দেখা যায় । জৈন ধর্মমতের প্রথম তীর্থংকর ঋষভনাথ এর সময় থেকেই দিগম্বর এর ধারণাটি পরিষ্কার হলেও শ্বেতাম্বর মতাম্বলম্বীদের মতাদর্শের সমর্থনে তেমন যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ পাওয়া যায়না ।

একথা অনস্বীকার্য , জৈনধর্মের  শ্বেতাম্বর শব্দের উৎস সন্ধানে যথাযথ তথ্যের অভাব ছাত্রজীবন থেকেই আমাকে অনুসন্ধানী করেছে । কিন্তু চব্বিশজন তীর্থংকর এর মধ্যে অজিতনাথ থেকে নমিনাথ পর্যন্ত তীর্থংকর এমন সুদূর সময়ের যেখানে শুধু কিংবদন্তি ও শ্রুতিঞ্জান ছাড়া আর কোনও কিছুর উপরই নির্ভর করা যায় না । তবুও সামান্য শাস্ত্রীয় তথ্য পেরিয়ে উনিশতম তীর্থংকর মল্লিনাথ এর কাছে পাওয়া যায় সেই উত্তেজনাময় সন্ধানের উৎস । পাওয়া যায় এক অনালোকিত ইতিহাসের ছোঁয়া। জৈন দিগম্বরদের প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে চব্বিশজন তীর্থংকরের সকলেই দিগম্বর এবং পুরুষ । অথচ শ্বেতাম্বর মতাবলম্বীরা উনিশতম তীর্থংকর মল্লিনাথের নারীত্বের মর্যাদা স্বীকার করেন । এবং তিনি শ্বেত অম্বর ব্যবহার করতেন । এই সূত্রই আমাকে উসকে দিয়েছে তীর্থংকর মল্লিনাথকে অনুসন্ধানের বিষয়ে ।

জৈন সাহিত্যপাথেদেখা যায় , খৃস্টপূর্ব  ভারতে পুরুষের মতো নারীরাও শিক্ষা – শাস্ত্র – শস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হতেন ।  ভারত সংস্কৃতির সেইসব আখ্যান সাহিত্যে প্রায় উপেক্ষিতই রয়ে গেছে । আমার অনুসন্ধিৎসার মেটাতে গিয়ে জৈন মঠ – মন্দির – লাইব্রেরী ( আমার নাগালের মধ্যে ) থেকে পেলাম প্রচলিত কিংবদন্তি ( মল্লিনাথ সম্পর্কে ) এবং অতিরঞ্জিত ভক্তিমূলক কাহিনি । হতাশ হলাম । জৈন তীর্থংকরদের বিষয়ে সর্বপ্রাচীন  কল্পসূত্রেও প্রকৃতসত্য বা বিশ্বাসযোগ্য জীবনচিত্র পাওয়া যায় নি । অথচ আমি চেয়েছি ধর্মীয় ধর্মীয় ভাবাবেগে মোহাবিষ্ট পঁচিশ ধনুষ উচ্চতা সম্পন্ন পঁয়তাল্লিশ হাজার বয়স্ক কলসলাঞ্ছন মল্লিনাথের বর্ণনাকে এড়িয়ে গিয়ে সেই সময়ে ভারতের সমাজে এক নারীর তীর্থংকর হয়ে ওঠার প্রকৃত সত্যকে উদ্ঘাটন করতে । ফলে আমার উপন্যাসে উঠে এসেছে তৎকালীন ভারতবর্ষের ধর্মীয় চেতনা ও যুক্তিগ্রাহ্য ভাবনার বিকাশ । আর , সেই আর্থ – সামাজিক প্রেক্ষাপটে সেই সময়ের রাজনৈতিক ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের অবস্থান । সর্বোপরি ষোড়শমহাজনপদ গড়ে ওঠার প্রাক্কালে ভারতীয় সমাজে নারীদের অবস্থান ।

জৈন ধর্মবিশ্বাস ( শেত্বাম্বর ) অনুসারে উনিশতম তীর্থংকর মল্লিনাথ ইক্ষাকু কুলসম্ভুত মিথিলারাজ কুম্ভের কন্যা মল্লিকা । কিংবদন্তি অনুসারে শাপগ্রস্ত ইক্ষাকু বংশীয় রাজা মহাবল জন্মান্তরে নারী রূপ পরিগ্রহ করেন এবং তিনিই তীর্থংকর মল্লিনাথ হিসেবে পরিচিত হন ।  প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে , তীর্থংকর মল্লিনাথ জৈনধর্মের আত্মাতত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা । যিনি বলেছেন , আত্মার বিনাশ নেই , এবং আত্মার  কোনও লিঙ্গ নেই , যেকোনো রূপেই তার প্রকাশ ঘটতে পারে । পরবর্তীকালে প্রবর্তিত  জৈনধর্মমতে এই তত্ত্বটি বিশেষ ভূমিকা পায় । সুতরাং জৈন ধর্মতত্ত্ব নয় কুম্ভরাজকন্যা মল্লিকার মল্লিনাথ হয়ে ওঠার কাহিনিই আমার ‘ তীর্থংকর মল্লিনাথ ’ । তাই এই উপন্যাসে কেবল আত্মাতত্ত্ব নয় প্রাচীন ভারতবর্ষের সার্বিক পরিচয়টিও পাওয়া যাবে । কিংবদন্তি ও জৈন পরম্পরায় বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলিকে অক্ষুন্ন রেখে পাঠকের হাতে তুলে দিতে চেয়েছি জৈন সংস্কৃতির এক অনালোকিত ইতিহাস ।

                                                     সমাপ্ত  

তথ্যসুত্রঃ ভারতীয় ধর্মের ইতিহাস – নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য / কল্পসুত্র -  বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত/ শ্রমণ ( পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যা ) / kalpasutra : Trans & Ed . by Herman Jacobi / A Competitive History of Jainism – A Chatterjee / মহাভারত / মহাভারতের সমাজ – শ্রী সুখময় ভট্টাচার্য্য শাস্ত্রী সপ্ততীর্থ /  Jain Jarnal  / Political Histry of Ancient India – H . Roychowdhury / Comprehensive Histry of Jainsm – A Chatterjee / ইন্টারনেট এর বিভিন্ন লিঙ্ক

যোগাযোগঃ তুষারকান্তি রায় , ‘ তুলিতোড়া ’ , সুভাষ বাগ , বিরাটি , কোলকাতা ৭০০০৫১ ।

মোবাইল – ৮০১৭৯৬৫৬০৪ / ৯৪৩৩৫৫৬৪০৩        

Friday 8 January 2021

সুবিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়,কবিতা,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,

 
 

 
 

 

 

প্রকৃতি বিষয়ক

যারা যারা সাঁকোটা পেরিয়ে গ্যাছে , অথবা যারা চেয়েছিল কিন্তু পেরোতে পারেনি। তাদের সকলের নাম মনে রাখবে নদী। কারণ তাদের সকলেরই ছায়া পড়েছে। কতটা সময় ধরে সেটা বিবেচ্য নয় কেবল। অভিযাত্রীর একটা গোটা ক্যারাভ্যান চলে গ্যাছে মরু পেরিয়ে। সকলেই যে ওপারে পৌঁছেছে এমন নয়। তবু যারা ওয়েসিসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছে , পেড়ে খেয়েছে মিষ্টি খেজুর , ছায়া ঢাকা সরোবরের নীল জল অথবা যারা মরীচিকা দেখে উপুড় হয়েছে বালির ওপর কিংবা  চোরাবালির নীচে আস্তানা গেড়েছে চিরতরে , তাদের সকলের জন্যই মরুভূমি আজ খুশি। লিখে রেখেছে এক একটা বালিয়াড়ির ছাদ বা তলায় তাদের প্রত্যেকের নাম অতি যত্ন করে , মনে রেখ এটা।

 

সিংহল যাত্রা


সুচয়ন তুলে আন ফুল!

দ্রাবিড় কোমরে গাঁথা মালা
নিতম্বে স্খলিত বসন।

সুচয়ন তুলে আন ফুল!

দ্রাবিড় অধরে দেখ রাঙা তাম্বুল
ঈষৎ রক্তাভ চোখ।

সুচয়ন তুলে আন ফুল!

অষ্টোত্তর শত ইন্দিবর , 
খোঁজ সহস্র সরোবর অযুত যোজন দূর।

সুচয়ন তুলে আন ফুল!

বাঁধ সাঁকো নীল অর্ণব
বানর সেনানী যত লাগে পাবে।

সুচয়ন তুলে আন ফুল!

অকাল বোধন যাত্রা
চলেছেন

দাশরথী রঘুবীর , বহিছে মৃদু মন্দ সমীর , 
দিনমণি গেল অস্তাচলে।

© সুবিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

পাঠ প্রতিক্রিয়াঃ সুধীর দত্তের কবিতা- অমিত সরকার,সাহিত্য এখন শীতসংখ্যা ২০২০-২১,


 

পাঠ প্রতিক্রিয়া

কালপুরুষের তরবারি

অমিত সরকার  

আমি জানি কবিতা কোনোদিন পৃথিবীর মুখ বদলে দিতে পারবে নাতবু প্রতিদিন ভোরবেলা যাপিত কনসেনট্রেশন   ক্যাম্পের ব্যালকনি থেকে আমি দেখি, অদ্ভুত এক আন্দোলনমুখর নীরবতার মধ্যে দিয়ে একা হেঁটে আসছে আমাদের বাংলা  কবিতাবিষণ্ণ কালিমাখা এবং কুয়াশাচ্ছন্ন এক আঁধার ঢেকে রেখেছে তার স্বাভাবিক হ্যালোএই মুহূর্তে শঙ্খ ঘোষ  বয়েসের ভারে নীরব, অলোকরঞ্জন সদ্য চলে গেলেন না ফেরার দেশে, জয় আর অতীতের মত স্বর্ণপ্রসবিনী নন, দেবদাস আচার্য বা সুব্রত সরকারও ইদানীং  সেভাবে আর প্রবল উপস্থিতিময় নন,  তাহলে বাঙলা কবিতা এখন কোন টাইটানদের  দিকে তাকিয়ে বিমুগ্ধ হবে ?

এইসব ভাবনামুহূর্তে আমি কখনো কখনো কবি সুধীর দত্তের কবিতাবইতে মুখ গুঁজিমনে করি আমার প্রতি স্নেহপ্রবণ একজন খর্বকায় আদ্যন্ত বাঙালি পুরুষের কথা  তাঁকে দেখলেই আমার মনে পড়ে, যেন মধ্যযুগের কোনো ডাচ মাস্টারের       আঁকা ছবি, হয়তো যিনি অনেকক্ষণ একাকী হেঁটে আসছেন পৌরাণিকতার দীর্ঘ রেশমপথ ধরে ধরেচোখ দুটিতে খেলা করছে এক গভীর আধ্যাত্মিক অনুভুতিমালাঅন্তরের আলোয় উদ্ভাসিত একজন পুরুষ, যিনি পড়তে পারেন প্রকৃতির নির্জন  গূঢ় শষ্পলিপিআত্মোপলব্ধি আত্মজিজ্ঞাসা যাকে করেছে সকলের চেয়ে আলাদাযার কবিতার গোধূলি শুধু রংরেখ নয়,  সেখানে লেগে আছে দার্শনিকতার এক দিব্য গৈরিক আভাসেভাবেই আমি আজ হাতে তুলে নিয়েছি তাঁর সাম্প্রতিকতম  সৃষ্টিঅথ লীলাবতী কথাযেখানে তাঁর কাব্যদর্শনের কেন্দ্রকোরক হল বিশুদ্ধতাযেখানে গণিত আর পুরাণ, দর্শন আর যাপন যুক্ত  হয়ে আছে এক অন্তরতম তরঙ্গদৈর্ঘ্যেসেই সংহত ভাবনাবিশ্বের যুক্তি যেখানে বদলে দিচ্ছে সময়প্রাচীন বাংলা কবিতার এযাবত লুসিড গতিপথবাক’-এর অসামান্য সৌন্দর্যকে তুলে আনছে চোখের পাতায়, কিন্তু কোন ইউটোপিয়ার মধ্যে  দিয়ে নয়, বরং ডিসটোপিয়ার এক মারাত্মক Vision-ভিশনএই কথাটির কোন সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ সম্ভবত হয় নাএই  কবিতাবইতে তাঁর ভিশন বা স্বপ্নভাবনা আমাদের পৌঁছে দিচ্ছে শাব্দিক যুক্তির এক লজিক্যাল ডিসকোর্সের উত্তরণে, যাকে কিটসের কয়েনেজ ধার করে আমি হয়তো বলতে পারি “Egotistical sublime” এর মধ্যে  যে মৃদু ভর্ৎসনা  মিশে আছে, তাই হয়তো কবি সুধীর দত্তের কালপুরুষের তরবারি, বাংলা কবিতার প্রতি এক প্রাকৃত  বার্তা   

 

বৈদিক ঋষি উবাচ, ‘মানুষের মধ্যে তাপরূপে যে অগ্নি রয়েছেন, তাঁকে ফুটিয়ে তুলতে হবে জ্যোতিরূপেএবং সেই জ্যোতি এক হয়ে যাবে দ্যুলোকের অগ্নি আদিত্যের সঙ্গেতখনদেহসারসৌ পুরুষঃ সোহহস্মিকবির এই বৃহৎ হওয়াই সম্ভবত  প্রকৃত কবিতা হয়ে ওঠাহ্যাঁ, একজন কবিই তো নিজে প্রকৃত একটি কবিতা হয়ে ওঠেন যখন তিনি ভূমায় দর্শন করছেননড়ে উঠছে শঙ্খিনি বাককে এই বাক ? তিনিই বেদসমূহের মাতা, ঐতরেয়   আরণ্যকে ইন্দ্রের সঙ্গিনী  হিসেবে তাঁর উজ্জ্বল পরিচিতি, আবার পরবর্তীতে তিনিই পরিগণিত হবেন দেবী সরস্বতী রূপে     কবি কি নিজেই তবে শব্দের আদিপিতা ? কারণ  মিথ বলছে শুরুতে তো ছিল সেই বিগ ব্যাং যা প্রকৃতপক্ষে এক ধ্বনি মাত্র  তাকে চেনার এই প্রজ্ঞাপারমিত সিদ্ধিই কি আজ কবিকে আয়ুর শেষ যামে ইন্দ্র বানিয়েছে ? তিনি রূপমুগ্ধতায়     তাই দেখছেন,  সেই প্রণম্য শঙ্খিনীর  নগ্ন মসৃণ উরু, অমর্ত্য নিতম্ব, শ্রোণীভার  তবে কি তিনিই  ঋষি অথর্বান, যিনি অসীম  প্রতিস্পর্ধায় উচ্চারণ করবেনশব্দেরা হোক কবির সমিধ’ ?  তিনিই কি বিনিয়োগ  করবেন শব্দকে, আর নিজে  ক্রমশ হয়ে উঠবেন ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী ?   

আমার মুগ্ধপাঠে এভাবেই শুরু হয় তাঁর অথ লীলাবতী কথা নামে কৃশকায় কবিতাবইটি, যার প্রথম কবিতাটির নাম   শঙ্খিনী বাকআমি জানি কবিও প্রতিদিনের বাস্তবতার খণ্ডগ্রাসে আমূল আক্রান্ত একজনজীবিকা ও সংসারের আদিক্ষেত্র   পেরিয়ে দূরবর্তী কোন পাড়াগাঁর হাটে তাঁর নিয়মিত ফিরে আসা এবং যাওয়াতবু এই খণ্ড খণ্ড মৌহুর্তিক জীবনের সেতুগুলি  যখন  নড়ে ওঠে তখনই আমরা বুঝতে পারি বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে তাঁর ও আমাদের প্রকৃত সঙ্গঠনার বর্ণমালাআগে এই  অদৃশ্য সেতুসমুহ,  যাতে মানুষ জুড়ে থাকত প্রকৃতি বা সমাজের সঙ্গে, তাকে সকলের উপযোগী করে সৃষ্টি করতেন যিনি,  তাঁকেই আমরা বলতাম কবিসেই কবেকার সরস্বতী সভ্যতার যুগে বাস্তবের পাশাপাশি এক সমান্তরাল ও পরিপূর্ণ জগত সৃজন করতেন তাঁরা  আমাদের সমস্ত খণ্ড অভিজ্ঞতার ডাইনামিক্স জুড়ে জুড়ে অন্য টাইম স্পেস বা দেশকালের এক বিচিত্র পরিসর নির্মিত হতপাঠকের মনের মধ্যে সেইসব মহাকব্যিক বিনির্মাণ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবার বদলে নিত  নিজেদেরথাকত চিরপ্রাসঙ্গিককবিরা তাই তখন স্বপরিচয়েই ছিলেন ঋষিকিন্তু সময়ের নিজস্ব ডিসকোর্সে আজ  খণ্ডচিত্রেরই প্রাধান্যতাৎক্ষনিকতার কোলাজ এখন ভাবতে শেখায় কবিতা কতকগুলি মুহূর্তের সমষ্টি মাত্রযে মুহূর্তগুলির মধ্যে আসলে কোন যোগাযোগই নেইসত্যিই কি নেই ? তবে কেন কবি লিখবেন

গত জন্মের জমিয়ে রাখা আকাশকান্না হয়ে ঝরছে মেঘ-

ভিজে যাচ্ছে সারাটা চাতাল

তোমার চোখের জলে লবণ নেই, তবু শব্দরা কিরকম

রে যাচ্ছে ক্রমশভিতর থেকে উঠে আসছে গোটা একটা

নক্ষত্রনগর

চলো, আমরা আর একবার তাঁকে বলি, এই তো ছোট্ট একটি চাওয়া- 

বাড়ি ফিরব, আমার এই নির্বাসন আর ভালো লাগছে না  - “আর এক দুধপথের দিকে     

 

কী সরল ও মহৎ এই উচ্চারণ, যার সামনে আজও নতজানু হয়ে বসতে হয় যেকোন অমেয় সভ্যতাকেশব্দেরা জরে  যাচ্ছেরেএই শব্দটিতে কী প্রাচীন, কী বাঙালি এক মায়া লেগেলেগে আছে যেন কোন গ্রাম্য ঠাকুমার বৈকালিক ডাক  এই অদ্ভুত  জারণবিন্দুকে স্পর্শ করে আমার মনে পড়ছেরবিঠাকুরের কপালে জলপটির মত নরম আঙুলের  কথাঅথচ কবি জানেনএই যে আলো দেখছ, যা এই পৃথিবীতে সবে পৌঁছল/ সে তারাটি বহু আগেই মারা গেছেএক জন্ম থেকে অন্য জন্মে এই যে পরিভ্রমণ, সে কী শুধু মিল্কিওয়ে ধরে ধরে ? অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের মধ্যে ঋষি রমনের  মায়াবাদে ? নাকি  এটি রোমানটিসিজমের এক অভিনব পুনর্জন্ম, যেখানে “ Ultimately it brings us back to the highway-only at a  greater evolution. We seek it first in the thunder and the earthquake of fantastic and bizzare. And find it after all in the small voice of everyday life”.

 

“ডাউকি নদী বরাবর ওই যে জাফলং, কেয়া ঝাড়,

তারই খুব গা ঘেঁষে তোমাদের গাঁ ?

ইচ্ছে হয় যাই।

একবার ছুঁয়ে আসি ঊরুসন্ধির মত দ্বীপভূমি।

তুমি কি ওখানে থাক ? শীতদেশ ? অন্ধকার ঝুপ করে নেমে

আসে ? আর তুমি একা

উঠোনে ছড়িয়ে হাঁটু, কিম্বা তুলসীতলায় খঞ্জনি

বাজাও আজও ?

স্বপ্নের পুরুষ আসবেন ?” – “পর্ণছায়ায়”   

আসলে হয়ত যা সহজ তাই সবচেয়ে সুন্দর। আর তার অভিঘাত যদি বেগপ্রবণ হয়, তাহলে তার হৃদয়গ্রাহ্যতা অনেক বেশি   দ্যুতিময় হয়ে ওঠে। কারণ আমরা তো জানি জীবন যতটুকু কেড়ে নেয়, দেয় তারও চেয়ে কিছু বেশি। আর এই জীবনপথের  সামান্য সেই পাওয়াটুকু  নিয়ে এগোতে এগোতে নিজেকেভালোবেসে ফেলে মানুষ তৈরি হয় আবার কিছু পাওয়ার, হয়তো নিজেকে প্রস্তুত করে দেওয়ার জন্যেও।          

 

আর একটি গভীর উচ্চারণ আমি ছুঁয়ে দেখি, নাম আদি পুরাণের গল্প 

 

নক্ষত্রের মৃত্যু আর আমাদের জন্মকথা লেখা হবে বলে

আমি তো শূন্যের দিকে সাদা খাতা বাড়িয়ে রেখেছি

সম্ভাব্যতার কোন সূত্র ছিল? লিখো, 

হাজার এক ভাবে যার প্রথম পৃষ্ঠাটি

শুরু হতে পারত, লিখো

সেই আদি পুরাণের গল্প,

যেমন বুকের দুধ, গর্ভ কাঠামো,

রামের জন্মেরও আগে যে রকম রামায়নী গান আর লব-কুশ,

আমরা কুশীলব, তুমি কবি,

আমার অবশ হাত তোমার হাতেই রাখা আছে

 

ঈশ্বরের কাছ থেকে আসার মুহূর্তে যে আলো আমাদের চোখে লেগে থাকে, তা বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে বুঝি ক্ষীণ, ক্ষীণতর হতে থাকেতাকে পুনরুদ্ধার করে আনে এক নির্জন স্মৃতিসেই বুঝি উত্তরণসেখানে সময় আর দেশ অর্থাৎ টাইম  অ্যান্ড স্পেসের অবস্থান ক্রমাগত পাল্টে যায়বিজ্ঞান তাকে সংজ্ঞায়িত করে ব্ল্যাক হোলবলেতবে কী কবি এখানে পাঠককে জুড়ে রেখেছেন  সেই ভাবনায় ?  সেই কৃষ্ণগহ্বর তো সত্যিই এক সম্ভাব্যতার শিল্পমাত্রযে এক আগ্নেয়গুহায়  ধারণ করে রেখেছে  মিথ ডিমিথ, এক রহস্যমেদুর স্মৃতি জন্মের সংকেতরহস্যসেখানে বারবার পাল্টে যাচ্ছে কুশীলব   অর্থাৎ  পাঠক, এবং কবি অর্থাৎ স্রষ্টার ভূমিকাআমার ব্যক্তিগত অনুভুতিমালা বলে এই চিন্তনপৃথিবীর গভীর গভীরতর  স্তরে জেগে আছে দুটি উল্লম্ব প্রতীক, যার প্রথমটি নিশ্চিতভাবে শব্দযা বহন করছে মানুষের সফল অসফল সমস্ত   অভিজ্ঞতা, চেতনা দ্বন্দের সারমর্ম, এবং দ্বিতীয়টি হলকবিযিনি ধারণ ব্যাখ্যা করছেন সেই সারমর্মের  সুধীরদার কবিতায় এই দুটি ধারণা, বারবার যেন প্রতীক অতিক্রম করে এক স্বাধীন স্বত্ত্বায় ডানা মেলছেহয়ে উঠছে এক নিরপেক্ষ যত্নে গুছিয়ে রাখা মায়াবাদএক অখণ্ড প্রবহমান বিশ্বাসের ভরকেন্দ্রযেখানে সত্যের বাহকশব্দএবং সত্যের ব্যাখ্যাতা   কবি’ , যিনি ঋষিও    

 

আর একটি কবিতায় ঘুরে আসা যাক   

যেন এক কিউবিক মোড়     

কোথ্থেকে যে উঠে যাচ্ছে, পতনের দিকে কোন সিঁড়ি

চকিতেই বেঁকে যায়,”  

 

 


 

শুরুতেই চলে আসছি এখানে দেওয়া M,C. Escher  (১৭ জুন ১৮৯৮ - ২৭ মার্চ ১৯৭২)  নামে এদেশের কবিদের কাছে   স্বল্প পরিচিত একজন ডাচ  শিল্পীর একটি বিখ্যাত ছবিতে এশার একজন ডাচ গ্রাফিক শিল্পী যিনি গাণিতিকভাবে অনুপ্রাণিত অসংখ্য উডকাট, লিথোগ্রাফ এবং মেজোটিন্টস এর এক অমর স্রষ্টাবিজ্ঞানীদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হওয়া  সত্ত্বেও,   এসার ও  তাঁর শিল্প  নেদারল্যান্ডসের শিল্প জগতেও দীর্ঘকাল  খানিকটা অবহেলিত ছিলতাঁর যে কোন কাজের বিশিষ্টতা  এতটাই,  যে সেখানে গাণিতিক অবজেক্ট  এবং অপারেশন বৈশিষ্ট্য  নির্মাণ করে এক অসম্ভব অবজেক্টিভ বিশ্ব, যেখানে  অনন্তের অন্বেষণ, প্রতিবিম্ব, প্রতিসাম্য, ও পারস্পেকটিভ জ্যামিতির বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা একইসঙ্গে ঘটে চলেবিজ্ঞান  জানা বা প্রযুক্তিআনন্দিত মানসের কাছে তাঁর ছবি এক গহীন ভাবনাবিশ্বের খনিস্বরূপ

এই কবিতাটির নাম এবং প্রথম লাইনের অভিঘাত হয়তো  কোন কোন পাঠককে  মনে করাবে গগন ঠাকুরের সেই আশ্চর্য সাদাকালো ছবিদের,  যাদের শিল্পকে ব্যকরণ সম্মত নাম  CHIAROSCURO ( এর সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ আমার  অজ্ঞাত) দিয়ে চিহ্নিত করা যায়কিন্তু পাঠকে পাঠকে তো দীক্ষায়  ও নিরীক্ষায় বিনির্মাণভেদ অতি স্বাভাবিকতাই আমার কাছে  এই সিঁড়ির উল্লেখ নিয়ে আসে এক ম্যাজিক রিয়ালিজমআমি যাকে বলতেই পারি “An enigma behind an illusion”এখানেও সেই সময় পরিভ্রমণপ্লেটোর উল্লেখ ( কি আশ্চর্য, এশারের মুখমণ্ডলের সঙ্গে কি আমি তাঁর কোন মিল খুঁজে   পাচ্ছি ?)  তাঁর সঙ্গে কী আমার দেখা হবে একটি কিউবিক পাতালের মোড়েসেখানেই তাঁর গার্হপত্যএই দুর্লভপুর, উখড়াডিহি হয়ে অমরক্যাননের রাস্তায় আমিও তো কতবার ভ্রমণ করেছি বাস্তবেইতবে কী স্বয়ং ঈশ্বরই লিখে রেখেছিলেন এখানে নিন্যা বচাংসি ”।    

 

আমরাও বিশুদ্ধ হই, যখন শুকতারা শুধু জাগে,

কথা বলি গণিত গননাতীতের,

আর এই নির্জনতম ক্ষণে দূরবর্তী দ্বীপের মতন   

ছায়াপথ---“   অথ লীলাবতীকথা 

 

কবিতাবইয়ের এই নাম কবিতাটি কবি উৎসর্গ করেছেন গণিতবিদ শ্রীনিবাস রামানুজমকে(এখানে প্রকাশ থাকুক গণিতবিদ দ্বিতীয়  ভাস্করাচার্য  এগারোশ সালে রচনা করেছিলেন লীলাবতীনামের এই গ্রন্থ,  তাঁর কন্যকার নামেপ্রকৃতপক্ষেসিদ্ধান্ত শিরোমণিমহাগ্রন্থের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের নামই লীলাবতী )

 

 

গণিত আসলে কী ? প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যেতে পারে সক্রেটিসের ব্যাখ্যা ধার করে। গ্রিক দার্শনিকের দাবি, পূজারিণী দিয়োতিমা মানুষকে দীক্ষা দেন বাসনা-মন্ত্রে। বাসনা বিবিধ। শারীরিক কাম চেতনা সবচেয়ে নিম্ন শ্রেণির বাসনা। আর সর্বোচ্চ লিপ্সা হল গণিত। যা কেবল সুন্দরের সন্ধানী। দিয়োতিমার আশীর্বাদে যারা খুঁজে পায় প্রিয়তম সুন্দরকে, তারা মজে প্রজনন লিপ্সায়। জৈবিক প্রজনন নয়, মনীষা-জাত সৃজন। সক্রেটিসের ব্যাখ্যা পরোক্ষে সমর্থন করেছেন দার্শনিক আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেড। যিনি গণিতকে বলেছেন, ‘মানবাত্মার শ্রেষ্ঠ মৌলিক সৃষ্টি’। আর হোয়াইটহেড-এর বন্ধু বার্ট্রান্ড রাসেল ? তিনি আত্মজীবনীতে জানান, গণিতে গভীরতর জ্ঞানার্জনের আকাঙ্ক্ষাতেই কেবল তিনি বিরত হয়েছিলেন আত্মহত্যা থেকে। তাঁর মতে শাস্ত্রটা যেন এক ভাস্কর্য— ‘শীতল এবং শুদ্ধ... গূঢ় মাত্রায় পবিত্র, কড়া মাপে সর্বাঙ্গসুন্দর’।

গণিত কেন সুন্দর? ব্যাখ্যা দিতে গণিতজ্ঞেরা উদাহরণ টানেন সংগীতের। বিবিধ বিচিত্র সুর আর ঝংকারের সমন্বয়ে যেমন শ্রবণের ঐন্দ্রজালিক মাধুর্য, গণিতও তেমনই এক ব্যাপার। নানা উপাদান, একটির সঙ্গে অন্যটি আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কহীন, অথচ যুক্তির সুতোয় গাঁথলে দেখা যাবে তারা এক অতীন্দ্রিয় অথচ অনিবার্য সম্পর্কে লিপ্ত। ওই সম্পর্কের আবিষ্কার গণিতচর্চাকে বানায় সৃজনশিল্প।

আ ম্যাথমেটিশিয়ান’স অ্যাপোলজি-তে হার্ডির ঘোষণা, ‘গণিতে আমার আগ্রহ কেবল তার সৃজনশিল্পে।’ তাঁর মতে, চিত্রশিল্পী  বা কবির মতো গণিতজ্ঞেরও উদ্দেশ্য প্যাটার্ন বা বিন্যাস রচনা। ওঁরা বিন্যাস গড়েন রং বা শব্দের সমন্বয়ে, আর গণিতজ্ঞ তা গড়েন নানা রকম ভাবনা দিয়ে। ওঁদের তুলনায় গণিতজ্ঞের তৈরি বিন্যাস যে বেশি স্থায়ী, তার কারণ সে বিন্যাসের উপাদান হল ভাবনা। তা সে যা-ই হোক, গণিতজ্ঞের রচিত বিন্যাস, চিত্রশিল্পী বা কবির সৃষ্টির মতো, সু্ন্দর হতে বাধ্য। রং বা শব্দের মতো ভাবনাগুলিকেও সুসংবদ্ধ হতে হবে। গণিতের প্রথম পরীক্ষা তার সৌন্দর্যে। সুন্দর না হলে এ জগতে তার আসন পাকা নয়।

“অথ লীলাবতী কথা” বা এই বইয়ের বিভাব কবিতার অন্তরতম বোধিতে আমি খুঁজে পাচ্ছি একই ভাবনার আরোহী,    অবরোহী  ? তাই তো সুধীর যখন লিখছেন,   

 

“তোমাকে ছোঁয়ার জন্য হে অনিশ্চয়তা,

হৃদয় আঁকপাঁক করে, আর সে কম্পন

আপাতালস্বর্গ ঢুঁড়ে নিয়ে আসে বেশ্যামাটি, কিছু খড়, তনহা ও বিষাদ।”

 

দীক্ষিত পাঠক এই কবিতার টানা ও পোড়েনে নিজেকে বিনির্মিত করছে বারবার। লীলাবতী তার কাছে হয়ে উঠছে শুদ্ধতম  গণিতের এক বাকপ্রতিমা, যার সঙ্গে মিলনের জন্য ছটফট করছে তার বোধের অনন্ত। আমাদের চকিতে  মনে পড়ে যায়   প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের কথা। মহাযান বৌদ্ধধর্মের অন্যতম প্রধান সূত্র এই প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্র। এই সূত্র বলে যে  প্রজ্ঞাপারমিতার সাথে মিলিত হতে হতে বুদ্ধ বুঝেছিলেন জীবনের অসারতার কথা আর তারপর তিনি প্রকৃত বুদ্ধ হয়ে ওঠেন।  তাই কি এই গভীর ছটফটানি ?  লীলাবতীর সঙ্গে মিলিত হবার জন্যে এই আকাঙ্খাবাস্পের বিস্ফোরণ।  নিশ্চিত সেই কারনেই কবি লেখেন,  

 

লীলাবতী ছাড়া আমি এক দণ্ডও বাঁচব না মা,

এমনকী যদি

উপড়ে ফেল গ্রহটিকে,”

 

কিছু কিছু কবিতার কোন ব্যাখ্যা  হয় না  হয়  না কিছু অনুভূতি বা গ্রহভারেরহওয়া উচিতও নয়তবে হয় না বলেই

 

খণ্ডিত বিবাহরেখা জানতেন আচার্য-পিতা

লীলাবতী, প্রিয় লীলাবতী!

তোমাকে ছুঁয়েছে এই হাত, যে হাত প্রলয় লেখে, অমরতা লেখে 

 

কবির দৃষ্টিতে এই লীলাবতী একজনদ্বা সুপর্ণাঅথবা পুরাণোক্ত দ্বিঠোঁট এক পাখি যার এক ঠোঁটে জীবন, অন্য  ঠোঁটে ধরা আছে মৃত্যুফলতিনি দেখছেন তার নাভির নীচের আগুন, তাঁর কাছে সে একদিকে শরীরবীজ নিয়ে দামাল প্রাকৃতিক বহ্নি, অন্যদিকে সেই ঈশ্বরের হস্তাক্ষরজীবনের গূঢ়লেখগোধূলিসন্ধির নৃত্যকলার মধ্যে ফুটে উঠছে তার আকাশভ্রমণসেই স্বয়ং কবি ও কবিতা হয়ে জ্বলে উঠছে ভাসমান সময়সমুদ্রে  

এখানে জীবনের  গাণিতিক বিপ্রতীপ হয়ে জ্বলে উঠছে একধুলপরিমাণ নূর  প্রশ্ন জাগে, কেন ধূলপরিমাণ ? সে কি এই ধুলোমাটি নির্মিত শরীরের সহবাসকথা বলে ? নাকি  সেই স্বয়ং Limit theorem, যেখানে শত চেষ্টাতেও  মেটানো যাবে না  অপরিমেয়কে, জেগে থাকবে ঈশ্বর বা গণিতের সেই অপরিমাপযোগ্য  দৈব ব্যর্থতা  নাকি এটাই সেই নিয়ম  সেখানে সংকেত পাঠায় সময় শরীর, অথবা কসমিক ধুলোকবি জানেন এই সংকেতে সাড়া দিতে তিনি বাধ্য    

কেননা আয়ুও স্বল্প, অতিজীবনের

জন্য মাত্র কটি দিন, সমান্তরাল পড়ে আছে   

 

অথ লীলাবতী কথা / সুধীর দত্ত 

সিগনেট প্রেস